শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

জর্নালঃ স্মৃতিচিত্র -- দাউদ হায়দার

কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছিল

মেঘের প্রবল খেলার ভঙ্গিতে আমি একা নিবিড় শুয়েছিলাম
                                                            কোমল শয্যার শরীরে  
আমার চারিদিকে বৃষ্টির নিপুন করতালি 
                                                       ডাকছিল আমাকে।
"আয় আয় ভিজে উঠি গুরুজনের দারুন চোখ ফাকি দিয়ে"--
যেন পেয়ে গেছে বালকবেলার সাথী!

কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছিল 
                                    টিনের ছাদে খেলছিল তুমুল 

যৌবনের ব্যাস্ত প্রেমিকের মতো ছুটেছিল পার্কে বাগানে--
নদী কি এখনো বসে আছে ভীষণ উৎকণ্ঠায়?
আমি তো মেঘের অনুচর            বিষে নীল গোলাপ
শহরময় হেঁটে গেলে ঘেমে যায় ক্ষয়িত পাথর 
আমি তো জ্যোৎস্নার শত্রু ঘন কুয়াশা বৃক্ষের বন্ধু!

আমার খেলার ভঙ্গিতে বর্ষাতি চাপিয়ে গায় হেঁটে যায় মহাজন
                                                                             রাজাধিরাজ
ব্যাকুল চেয়ে থাকে সম্রাজ্ঞীর করুন হৃদয়             কিশোরীর বুক
আমি তো খেলছি এই মধ্যরাতে; টিনের ছাদে খেলছি একা একা 
                                                                                                সখী নেই 
আমি তো এক্ষুনি চলে যাবো বিষণ্ণ মেঘের ইশারায় 
                                                                           হয়তো বা
সেই মেঘ ভেবেছিল বহুবার? 

আমি একা শুয়ে আছি; নিবির শুয়ে আছি  
                                                         কোমল শয্যার শরীরে 
সেই বৃষ্টি এখনো কি সখী বিনা ঘুরে বেড়ায় আকাশের একলা পথে 
আমি যেমন শুয়ে আছি এই বিজন ঘরে?

১২।০৭।১৯৭২ 
গ্রন্থঃ জন্মই আমার আজন্ম পাপ। 

মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

জন্মই আমার আজন্ম পাপ- দাউদ হায়দার।

জন্মই আমার আজন্ম পাপ, মাতৃজরায়ু থেকে নেমেই জেনেছি আমি
সন্ত্রাসের ঝাঁঝালো দিনে বিবর্ণ পত্রের মত হঠাৎ ফুৎকারে উড়ে যাই
                                                              পালাই পালাই সুদূরে
চৌদিকে রৌদ্রের ঝলক
বাসের দোতলায় ফুটপাতে রুটির দোকানে দ্রুতগামী নতুন মডেলের
চকচকে বনেটে রাত্রির জমকালো আলো ভাংগাচোরা চেহারার হদিস


ক্লান্ত নিঃশব্দে আমি হেঁটে যাই
পিছনে ঝাঁকড়া চুলওয়ালা যুবক। অষ্টাদশ বর্ষীয়ার নিপুণ ভঙ্গী
দম্পতির অলৌকিক হাসি প্রগাঢ় চুম্বন
কাথায় জরানো শিশুর অসতর্ক চিৎকার
এবং
আমি দেখে যাই, হেঁটে যাই, কোথাও সামান্য বাতাসে উড়ে যাওয়া চাল-
                                                               অর্থাৎ আমার নিবাস।

ঘরের স্যাঁতসেতে মেঝেয় চাঁদের আলো এসে খেলা করে
আমি তখন সঙ্গমে ব্যর্থ, স্ত্রীর দুঃখ অভিমান কান্না
                                            সন্তান সন্তুতি পঙ্গু
পেটে জ্বালা, পাজরায় তেল মালিশের বাসন উধাও-

আমি কোথা যাই? পান্তায় নুনের অভাব।

নিঃসংগতাও দেখেছি আমি, উৎকন্ঠার দিনমান জ্বলজ্বলে বাল্বের মতোন
আমার চোখের মতো স্বজনের চোখ-

যেন আমুন্ড গ্রাস করবে এই আমাকেই
আমিই সমস্ত আহার নষ্ট করেছি নিমেষে।

শত্রুর দেখা নেই, অথচ আমারি শত্রু আমি-
জ্বলন্ত যৌবনে ছুটি ফ্যামিলি প্ল্যানিং কোথায়
                   কোথায় ডাক্তার কম্পাউন্ডার
               যারা আমাকে অপারেশন করবে?
পুরুষত্ব বিলিয়ে ভাবি, কুড়ি টাকায় একসের চাল ও অন্যান্য
                                        সামান্য দ্রব্যাদী মিলবে তো?

আমার চৌদিকে উৎসুক নয়ন আহ্লাদী হাসি ঘৃণা আমি পাপী

এরা কেন জন্ম নেয়? এরাই তো আমাদের সুখের বাধা অভিশাপ।
মরণ এসে নিয়ে যাক, নিয়ে যাক
                               লোকালয়ের কিসের ঠাঁই এই শত্রুর? -বলে
                               প্রাসাদ প্রেমিকেরা

আমিও ভাবি তাই, ভাবি নতুন মডেলের চাকায় পিষ্ট হবো
আমার জন্যই তোমাদের এত দুঃখ
       আহা দুঃখ
       দুঃখরে!

আমিই পাপী, বুঝি তাই এ জন্মই আমার আজন্ম পাপ।

০২।০২।১৯৭২

বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

রূপম-সুবোধ সরকার

রূপমকে একটা চাকরি দিন—এম. এ পাস, বাবা নেই
আছে প্রেমিকা সে আর দু’-এক মাস দেখবে, তারপর
নদীর এপার থেকে নদীর ওপারে গিয়ে বলবে, রূপম
আজ চলি
তোমাকে মনে থাকবে চিরদিন
রূপমকে একটা চাকরি দিন, যে কোন কাজ
পিওনের কাজ হলেও চলবে |
তমালবাবু ফোন তুললেন, ফোনের অন্য প্রান্তে
যারা কথা বলেন
তাদের যেহেতু দেখা যায় না, সুতরাং তারা দুর্জ্ঞেয় |
তমালবাবু মামাকে বললেন কূপমের একটা চাকরি দরকার
মামা বললেন কাকাকে, কাকা বললেন জ্যাঠাকে,
জ্যাঠা বললেন
বাতাসকে |
মানুষ জানলে একরকম, কিন্তু বাতাস জানলে
প্রথমেই ছুটে যাবে দক্ষিণে, সে বলবে দক্ষিণের অরণ্যকে
অরণ্য বলবে আগুনকে, আগুন গেল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে
আলিমুদ্দিন ছুটল নদীকে বলার জন্য
নদী এসে আছড়ে পড়ল
উপকূলে, আসমুদ্র হিমাচল বলে উঠল
রূপমকে একটা চাকরি দাও, এম. এ. পাশ করে বসে আছে ছেলেটা |
কয়েক মাস বাদের ঘটনা, আমি বাড়িফিরছিলাম সন্ধেবেলায়
গলির মোড়ে সাত-আটজনের জটলা দেখে থমকে দাঁড়ালাম
জল থেকে সদ্য তুলে আনা রূপমের ডেডবডি
সারা গায়ে ঘাস, খরকুটো, হাতের মুঠোয়
ধরে থাকা একটা এক টাকার কয়েন |
পাবলিক বুথ থেকে কাউকে ফোন করতে চেয়েছিল, রূপম?
ভারত সরকারের এক টাকা কয়েনের দিকে আমার চোখ |
সারা গায়ে সবুজ ঘাস, ঘাস নয়, অক্ষর
এম. এ. পাস করতে একটা ছেলেকে যত অক্ষর পড়তে হয়
সেই সমস্ত ব্যর্থ অক্ষর ওর গায়ে লেগে আছে |
একটা ছেলেকে কেন আপনারা এম. এ. পড়ান, কোন আহ্লাদে আটখানা
বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়েছেন? তুলে দিন
এই কথাগুলো বলব বলে ফোন তুললাম পবিত্র সরকারের
ফোন বেজে উঠল, ফোন বেজে চলল, ফোন বেজেই চলল
২০ বছর ধরে ওই ফোন বেজে চলেছে, আরো কুড়ি বছর বাজবে |
বাতাস বলছে অরণ্যকে, অরণ্য চলেছে নদীর দিকে
নদী উপকূল থেকে আছড়ে পড়ে বলল :
রূপমকে একটা চাকরি দিন |
কে রূপম?
রূপম আচার্য, বয়স ২৬, এম. এ. পাস
বাঁ দিকের গালে একটা কাটা দাগ আছে |

শিয়রে বাংলাদেশ- নির্মলেন্দু গুন।

আমার যখন পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়েছিলো,
তুই তখনও ছিলি আমার স্বপনে।
আমি পাঁজর খুলে বলেছিলাম তোকে,
আমার বুকে যা আছে তুই সব নে ॥
আমার যখন পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়েছিলো,
তুই তখনও ছিলি মায়ের ভ্রণে।
আমি অস্ত্রজ্ঞানে আড়াল করে তোকে
তীর বানিয়ে রেখেছিলাম তূণে ॥
আমার যখন পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়েছিলো,
তুই তখনও ছিলি জন্ম-আশায়।
তোকেই তখন বড় করে দেখেছিলাম বলে
সঁপিনি মন নারীর ভালোবাসায় ॥
আমার যখন পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়েছিলো,
অস্ত্র তুলে নিয়েছিলাম হাতে।
যুদ্ধ করতে গিয়েছিলাম দূরপাহাড়ী বনে
যদিও সায় ছিলো না হত্যাতে ॥
আমার যখন পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়েছিলো,
টগবগে লাল রক্ত ছিলো বক্ষে।
তখন তোকে নরক থেকে মুক্ত করা ছাড়া
আর কী শ্রেয় ছিলো আমার পক্ষে ?
আমার যখন পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়েছিলো,
বিজয়-গর্ব ছিলো না তোর স্বরে।
আমি তোকে বিজয় দিয়ে বিজয়বতী করে
দিয়েছিলাম ষোলোই ডিসেম্বরে ॥
এখন যখন পঁচিশ বছর পূর্ণ হলো তোর,
আমি তখন তোকে রেখে পঞ্চাশে দেই দৌড়।
রজতে নয়, সুবর্ণতে এ-দৌড় হবে শেষ,
তখনও তুই থাকবি আমার শিয়রে বাংলাদেশ।

আহা আজি এ বসন্তে-রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর।

আহা আজি এ বসন্তে
এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে
এত পাখি গায় আহা আজি এ বসন্তে।।
সখির হৃদয় কুসুম কোমল
আর অনাদরে আজি ঝড়ে যায়
কেন কাছে আস, কেন মিছে হাসো
কাছে যে আসে তো, সে তো আসিতে না চায়।।
সুখে আছে যারা সুখে থাক তারা
সুখের বসন্ত সুখে হোক সারা
দুঃখিনী নারীর নয়নেরও নীড়
সুখি জনে যেন দেখিতে না পায়
তারা দেখেও দেখে না তারা বুঝেও বোঝেনা
তারা ফিরেও না চায়।।

ফুল ফুটুক না ফুটুক- সুভাষ মুখোপাধ্যায়।

ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।

শান-বাধানো ফুটপাথে
পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাটখোট্টা গাছ
কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে
হাসছে।

ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।

আলোর চোখে কালো ঠুলি পড়িয়ে
তারপর খুলে-
মৃত্যুর কোলে মানুষকে শুইয়ে দিয়ে
তারপর তুলে-
যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে
যেন না ফেরে।

গায়ে হলুদ দেওয়া বিকেলে
একটা দুটো পয়সা পেলে
যে হরবোলা ছেলেটা
কোকিল ডাকতে ডাকতে যেত
- তাকে ডেকে নিয়ে গেছে দিনগুলো।

লাল কালিতে ছাপা হলদে চিঠির মতো
আকাশটাকে মাথায় নিয়ে
এ- গলির এক কালোকুচ্ছিত আইবুড়ো মেয়ে
রেলিঙে বুক চেপে ধরে
এইসব সাত পাঁচ ভাবছিল।

ঠিক সেই সময়
চোখের মাথা খেয়ে গায়ে উড়ে এসে বসলো
আ মরন! পোড়ামুখ লক্ষ্মীছাড়া প্রজাপতি!

তারপর দড়াম করে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ।
অন্ধকারে মুখ চাপা দিয়ে
দড়ি পাকানো সেই গাছ
তখন ও হাসছে। 

মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

প্যারিস রোড- সাইদ জামান

দেখেছো চাঁদ কিভাবে হাসছে ঐ গগনশিরিশের ফাকে উঁকি মেরে
দেখো কেমন বৃষ্টির মতো ঝড়ে পড়ছে জ্যোৎস্নার আলো
এই সোডিয়াম বাতি গুলো যদি নেভানো যেত
তোমাকে প্যারিস রোডের আসল সৌন্দর্য দেখাতে পারতাম
জানো আমার কেন যেন মনে হয়
আমি সহস্র বছর ধরে হেটে চলেছি এই পথ ধরে
দুচোখ ভড়ে দেখেছি শুধু দেখেছি
ওহো তোমাকে তো শিশিরসিক্ত ভোরের প্যারিস রোড দেখানো হয়নি
একদিন খুব ভোরে তোমাকে নিয়ে আসবো
একদম কিচির মিচির ভোঁরে
আর হ্যাঁ পড়ন্ত বিকেলের প্যারিস রোড ও কিন্তু দেখাবো তোমায়
দেখবে কেমন হলদেটে হয়ে ওঠে আশপাশ
তবে যদি ঝুম বৃষ্টিতে প্যারিস রোডে না হেটে থাকো
তবে আজীবন আমার চোখে হতভাগী হয়েই থাকবে।।

শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

তোমাকে ছাড়াও কবিতা -সাইদ জামান

তোমাকে ছাড়াও তো আমি বেচে আছি
দিব্যি শুয়ে বসে দিনতো কেটে যাচ্ছে
শুধু মাঝে মাঝে কাছের জিনিস ও কেমন ঝাপসা হয়ে ওঠে।।

তোমার পাশে না থেকেও তো আমি বেচে আছি
দিব্যি বসে জ্যোৎস্না দেখি
শুধু মাঝে মাঝে বুকের কাছে কে যেন খামচে ধরে।।

তোমাকে হারিয়েও তো আমি বেচে আছি
দিব্যি ঘাসফুল দেখে খুশি হয়ে উঠি...
শুধু মাঝে মাঝে কেমন চারপাশটা ফাঁকা হয়ে যায়।।

তোমার হাত ধরে না থেকেও তো আমি বেচে আছি
দিব্যি শরতের মেঘ জড়িয়ে ভাসতে ইচ্ছে করে
শুধু মাঝে মাঝে নিজেকে সুতো ছেড়া ঘুড়ির মতো মনে হয়।।