শুক্রবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১৪

হেলাল হাফিজ এর নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়।

হেলাল হাফিজ এর দুইটি মাত্র কাব্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এ পর্যন্ত। প্রথমটি "যে জলে আগুন জ্বলে" ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয়।দ্বিতীয় টি "কবিতা একাত্তর" ২০১২ সালের বই মেলায় প্রকাশিত হয়। কি এক অজানা অভিমানে মাঝখানের এতগুলো বছর এই অসাধারণ কবি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল সমাজ থেকে। তবে সুখকর তিনি নিজেকে কবিতা থেকে গুটিয়ে নেন নি। এসময়ে তিনি লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা। খুব শীঘ্রই কবিতা প্রকাশ করবেন বলে জানিয়েছেন কবি। 


হেলাল হাফিজ

হেলাল হাফিজ এর নিষিদ্ধ  সম্পাদকীয় কবিতাটি স্লোগান হিসেবে ব্যাবহারিত হয়েছে, ব্যাবহারিত হয়েছে দেয়াল লিখন হিসেবে। "এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়" - এদুটো লাইন বাঙ্গালির সকল অধিকার আদায়ের আন্দোলনে উত্তেজক হিসেবে ব্যাবহারিত হয়েছে।  ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে, ১৯৯০ এর জে. এরশাদ সরকার বিরোধী ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে অসংখ্য গণআন্দোলনে, মিছিলে, মিছিলে, গণসমাবেশে, দেওয়াল লিখনে, আন্দোলনের মঞ্চে অসংখ্যবার উদ্ধৃত হয়েছে এই অজয় কবিতা।কবিতা টি কবিকে দিয়েছে এক অসাধারণ স্থান। 



নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়।

এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
মিছিলের সব হাত
কন্ঠ
পা এক নয় ।

সেখানে সংসারী থাকে, সংসার বিরাগী থাকে,
কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার ।
কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার
শাশ্বত শান্তির যারা তারাও যুদ্ধে আসে
অবশ্য আসতে হয় মাঝে মধ্যে
অস্তিত্বের প্রগাঢ় আহ্বানে,
কেউ আবার যুদ্ধবাজ হয়ে যায় মোহরের প্রিয় প্রলোভনে
কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনী হতে হয় ।

যদি কেউ ভালোবেসে খুনী হতে চান
তাই হয়ে যান
উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায় ।

এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় ।




কিন্তু কেন লিখেছিল কবি এমন একটি কবিতা? কি ছিল তার প্রেক্ষাপট? কবির নিজের ভাষায় ই শোণা যাক। 


দেখুন, একটি কবিতা একটানেই হয়তো লেখা হয়, কিন্তু এর নির্মাণ প্রক্রিয়া মাথার ভেতরে চলে দীর্ঘ সময় ধরে। বিখ্যাত লেখকেরা একে বলেন, প্রস্তুতিপর্ব। এটি নির্ভর করে শুধু কাব্যভাবনার ওপরে নয়, কবির চারপাশে যা ঘটছে, যা কবিকে ভাবাচ্ছে, অথবা কবি যা ভাবতে চান, সব কিছুর ওপর। বিষয়টি একটি ছোট্ট চারাগাছের জন্মের সঙ্গেই তুলনা করে চলে। এক সকালে আপনি দেখলেন, অনুর্বর জমিতে হয়তো উঁকি মেরেছে একটি ছোট্ট চারাগাছের দুটি কিশলয়। এটি আপনা-আপনি, নিজে নিজে প্রকৃতিতে ঘটে না। চারাগাছ জন্মের জন্য সুস্থ-সবল বীজ চাই। বীজটি সঠিক জমিতে, সঠিক আলো-হাওয়ায়, সঠিক সার-পানিতে বোনা চাই। তবেই এটি হয়তো একদিন মাটি ভেদ করে সূর্যের আলো দেখবে। কবিতাও ঠিক তেমননি। এটি কবিই কলমে দিয়ে কাগজে অক্ষর দিয়ে ফুঁটিয়ে তোলেন ঠিকই। কিন্তু এর নির্মাণকাল চারাগাছের জন্ম নেওয়ার মতোই একটি ঘটনা। গাছটি উপকারি হলে মানুষ যেমন একে যতœ করে যুগ যুগ বাঁচিয়ে রাখে, তেমনি কবিতাও মানুষের মনে আঁচড় কাটতে সক্ষম হলে এর পাঠকরাই একে যতœ করে বছরের পর বছর ধরে বাঁচিয়ে রাখে। …

সেটি ছিল ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাস। টগবগে লাভার ভেতরে ফুটতে থাকা উত্তাল পূর্ব বাংলা। ছাত্র-গণঅভূত্থানের সময়। ২১ জানুয়ারির বিকেলে শুনশান, নিস্তব্ধ এক অচেনা নগরীর পথ ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বন্ধুর রুমে রাতটুকু কাটানোর জন্য রিকশা ধরে যাচ্ছি। সন্ধ্যার পরেই আরো সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কায় দ্রুত আশ্রয়ে ফেরার জন্য সকলেরই খুব তাড়া। এর আগেরদিনই ২০ জানুয়ারি পাক-সামরিক জান্তার লেলিয়ে দেওয়া পুলিশ- ইপিআর বাহিনীর (ইপিআর, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, সীমান্তরক্ষী বাহিনী) গুলিতে নিহত হয়েছেন ছাত্র নেতা আসাদ। পুরো ঢাকা শহর ক্ষোভের জ্বলছে। সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে গণ-বিক্ষোভ। ঢাকার এখানে-সেখানে ছাত্র-জনতা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। মিছিলের পর মিছিল। শ্লোগানের পর শ্লোগান। বিশালাকায় মিছিল-সমাবেশের আয়তন। প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের গুলিতে কোনো না কোনো ছাত্র মারা যাচ্ছেন। তবু জনতার সংগ্রাম চলছেই। …

রিকশায় বসে বন্ধুর ছাত্রবাসে ফিরতে ফিরতে এইসবই ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথার ভেতর। এরপর করণীয় কী? কি হবে বাংলার ভবিষ্যত? যুদ্ধ কি সত্যিই আসন্ন? স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হচ্ছে কবে? রিকশা যখন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বর পেরিয়ে যাচ্ছে, তখন অস্থিরতার ভেতরেই বুড়ো মতোন রিকশা ওয়ালাকেই জিজ্ঞাসা করি, আচ্ছা চাচা মিয়া, বলেন তো, এই যে ছাত্ররা প্রতিদিন মিছিলে গুলি খেয়ে মরছে, তবু আন্দোলন চলছেই, এর শেষ কোথায়? আর কতো গুলি চলবে? আর কতো রক্তক্ষয় হবে? এখন কি করণীয়? বুড়ো রিকশাওয়ালা ঘাড় ঘুরিয়ে নিয়ে আমাকে এক নজর দেখে সেদিন যা বলেছিলেন, তা এখনো স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন ওই বুড়ো আমাকে বলেছিলেন, বাবা, কিছু মনে করো না। আমার মনে হয়, অনেক ছাত্র খুন হইছে। এখন এর বিহিত করনের সময় হইছে। এখন ছাত্রদেরও উচিত হইবো কিছু পুলিশ-ইপিআর মাইরা ফেলা। কারণ, সব হত্যায় পাপ নাই!
এই কথা শুনে সেদিন আমার সর্ব শরীর কেঁপে উঠেছিল। কথাগুলো একদম কলজের ভেতরে গেঁথে যায়। বন্ধুর ছাত্রাবাসের রুমে গিয়ে আমি ভেতরে ভেতরে আরো অস্থির হয়ে উঠি। সেখানেও তখন ছাত্ররা মিছিল-মিটিং, আন্দোলন-সংগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছে। হাতে লেখা পোস্টার তৈরি হচ্ছে। সর্বত্র যুদ্ধের আবহ। রাত হতে না হতে ক্যাম্পাসের শুনশান নিরবতা ভেদ করে দূর থেকে ভেসে আসতে থাকে শ্লোগানের ধ্বণী। সেদিন রাতে অনেক চেষ্টা করেও আর ঘুমাতে পারিনি। বার বার মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল বুড়ো রিকশাওয়ালার সেই কথাগুলো। কি যন্ত্রণায় মনে মনে ছটফট করতে করতে ভোর রাতে উঠে রুমের বাতি জ্বালাই। কাগজ-কলম টেনে নিয়ে একটানে লিখে ফেলি ওই কবিতাটি:

"কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনী হতে হয় ।
যদি কেউ ভালোবেসে খুনী হতে চান
তাই হয়ে যান
উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায় ।
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় ।"

পরে সকাল হওয়ার জন্য অপেক্ষা করি। তখন আমাদের তরুণ কবিদের প্রেরণাদাতা ছিলেন আহমদ ছফা, ছফা ভাই। এখন যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ, এর উল্টোদিকের মাঠের এককোনো তখন ঝুপড়ি একটি রেঁস্তোরা ছিলো। আমরা কবি-সাহিত্যিকরা সেখানে বসেই আড্ডা দিতাম। ছফা ভাই প্রতি সকালে সেখানে আসতেন নাস্তা করতে। আমি দোকানটিতে গিয়ে ছফা ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। তিনি এলে পকেট থেকে কবিতা লেখা কাগজটি বের করে তাকে দেখাই। ছফা ভাই কবিতাটি একবার-দুবার পড়েন। এরপর আবারো পড়েন। তারপর হঠাৎ উল্লাস করে আমাকে জড়িয়ে ধরেন। বলেন, হেলাল, তুমি বোধহয় তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ লেখাটি লিখে ফেলেছো! এই কবিতাটিতেই তুমি আজীবন বেঁচে থাকবে।
সেদিন ছফা ভাই ওই কথা কেনো বলেছিলেন, বুঝতে পারিনি। পরে কবিতাটি ছফা ভাই উদ্যোগ নিয়ে লিফলেট আকরে প্রকাশ করেন। ছাত্র-জনতা কবিতাটিকে সারা বাংলায় ছড়িয়ে দেন। এটি অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরিস্থিতির কারণেই তখন কবিতাটি কোনো সংবাদপত্রে প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। …
তবে ছফা ভাই সেদিন বোধহয় ঠিকই বলেছিলেন। এরপর অনেক কবিতা লিখেছি। এখনো লেখার চেষ্টা করছি। প্রেমের কবিতা, প্রকৃতির কবিতা, সংগ্রামের কবিতা। কিছু কিছু কবিতা পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে ঠিকই। কিন্তু কোনো কবিতাই কখনোই ওই কবিতাটির জনপ্রিয়তাকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। … একজন কবি জীবদ্দশায় তার নিজেরই লেখা একটি কবিতার এমন অবিশ্বাস্য জয়-জয়াকার দেখেছেন, এটি ওই কবিতার জনক হিসেবে আমার কাছে অনেক বড়ো পাওয়া। কবিতা বা জীবনের কাছে আমার আর কোনো প্রাপ্তি নেই।
কবির এই কথোপকথনটি সে সময় প্রয়াত সাংবাদিক মিনার মাহমুদ সম্পাদিত জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ‘বিচিন্তা’য় ছাপা হয়। এর শিরোনাম ছিলো: ‘কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনী হতে হয়’।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন