মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই, ২০১৪

একটি চিঠি- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

বলাকা তোমার শুভ্র চোখেতে পায়নি ঘুম ?
জানোনা কি এটা কুয়াশায় ঢাকা
রাত নিঝুম !
স্বপ্ন দেখো না ? এখনো কি তার
সময় নয় ?
বলাকা, তুমি কি পেয়েছো ভয় ?
জানো নাকি আমি পথে ঘুরে-ঘুরে দিশেহারা-
আকাশের মায়া গান গেয়ে করে
গৃহছাড়া।
তোমার বাশিতে ফুঁ দিয়েছি আমি
সেই ধ্বনি-
বলাকা এই কি জাগরণী ?
মরু পর্বতে ঘুর্ণিঝড় যে হোল শুরু ।
আকাশের বুকে মেঘশিশুদের
গুরু গুরু ।
হিংস্র নখর এখনো লুকোয় বাকে-বাকে
সরল কুমারী বোকা চোখে শুধু
চেয়ে থাকে ।
সমুদ্র-ঝড় আসেনি এখনো মনে-মনে ?
বলাকা-হৃদয় এখনও কি শুধু দিন গোনে ।
মন উত্তাল পাখি শুধু ডাকে বোবা যুগে ,
ফেরারী বাহিনী বছর কাটায়
উদ্যোগে ।
মনের সূর্য তবুও ভাংবে অন্ধ ঘোর
বলাকা, তুমি কি দেখনি ভোর ?
হৃদয় জাগানো পরশমণির সন্ধানেই
তাই তো অলস দুপুর যাপনে
শঙ্কা নেই ।
স্বপ্ন-সাগরে দিয়েছি নিজেকে
বিসর্জন
বলাকা, তোমার গ্রন্থি হবেনা উন্মোচন ?



 বি.দ্রঃ ১৯৫২ সালের ২৯ মার্চ সংখ্যার দেশ পত্রিকাতে প্রথম প্রকাশিত হয় সুনীলের প্রথম কবিতা একটি চিঠি। কবির বয়স তখন ছিল ১৭। কবিতাটি এক কিশোরীর মন পাওয়ার আশায় রচিত। কারণ সুনীল জানতেন, সেই কিশোরীর বাসায় অন্যান্য পত্রিকার সঙ্গে রাখা হতো দেশ পত্রিকাটি। তাই তার মন পাওয়ার জন্য অথবা নিজের অব্যক্ত কথা ব্যক্ত করার জন্য বের করলেন অভিনব এক বুদ্ধি। নিজেকে কবি হিসেবে কিশোরীর কাছে পৌঁছানোর অন্য কোনো উপায় না পেয়ে একরকম পথ বেছে নেন তিনি। সুনীলের নিজের কথায় - ‘একটি রচনা ঝোঁকের মাথায় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ‘দেশ’ পত্রিকায়। বিস্তারিত জানতে এই লিংক এ যান।

সোমবার, ১৪ জুলাই, ২০১৪

এলোমেলো

আমার সুনীল এর মতো কোণ দ্বীপ নেই
যেটা বেঁচে একটা নদী কিনে ফেলতে পারতাম
নেই জীবনানন্দের মতো বনলতা সেন
যার জন্য হাজার বছর আমি পথ হেঁটে যাবো।
আমি খুব সাধারন, চিরায়ত
বহুদুর পানে নির্নিমেষ চেয়ে থাকা
সপ্নাতুর এক বোহেমিয়ান।

শীতের সকালে শিশির স্নাত একটা ঘাস ফুলের জন্য
রোদেলা দুপুরে একটু ছায়ার জন্য
পড়ন্ত বিকেলে একটি সুতো ছেড়া ঘুড়ির জন্য
মাঝ রাতে মাথা নুইয়ে থাকা লাম্পপোষ্ট এর জন্য
ধান শালিকের বেশে নয়
আমি বারংবার আমি হয়ে ফিরতে চাই
এই একি আমি হয়ে
আমিত্বের অমরত্বের প্রত্যাশায়।।


১৪.০৭.২০১৪

রবিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৪

অশ্রুবিন্দুতে চাঁদের প্রতিবিম্ব

আজ আকাশে আলোর বিস্ফোরণ
রাতের অন্ধকার ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে
ডোবার জলে চিকচিকে আলো
ভয়ংকর একটা চাঁদ তার সৌন্দর্য দিয়ে
যেন গ্রাস করে নিতে চাচ্ছে
জাগতিক সকল পঙ্কিলতা।

হাজার মাইল দূরে যে শিশুটি
মৃত্যু ভয়ে কুচকে আছে
ওখানেও কি আজ এমন জ্যোৎস্না?
এমন ভয়ংকর সুন্দর চাঁদ কি আজ গাজার আকাশেও উঠেছে?
শিশুটির চোখের কোনে জমে থাকা অশ্রুবিন্দু
সেখানেও কি চাদের আলো পরছে?
ওখানে আজ চাঁদ না উঠলেও পারতো
অন্ধকারে ডুবে থাকতে পারলে শিশুটি বেঁচে যেত
কে চায় এমন অপার্থিব জ্যোৎস্না
যে জ্যোৎস্নার আলো পাশে নিথর পরে থাকা মায়ের মুখে পড়ে।

আজ চাঁদ ডুবে যাক
আমি দেখতে চাইনা তার নির্লজ্জ চেহারা
আজ আধারে ঢেকে যাক
আমি দেখতে চাই না অশ্রুবিন্দুতে চাঁদের প্রতিবিম্ব।

১২.০৭.২০১৪

বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই, ২০১৪

চিনতে পারোনি? -সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

যে-কোনো রাস্তায় যে-কোনো লোককে ডেকে বলো,
তুমি আমার বাল্যকালের খেলার সঙ্গী,
মনে পড়ে না?
কেন তোমার ব্যস্ত ভঙ্গি?
কেন আমায় এড়িয়ে যাবার চঞ্চলতা!
আমার অনেক কথা ছিল, তোমার জামার বোতাম ঘিরে অনেক কথা
এই মুখ, এই ভূরুর পাশে চোরা চাহনি,
চিনতে পারেনি?
যে-কোনো রাস্তায় যে-কোনো লোককে ডেকে বলো,
আমি তোমার বল্যকালের খেলার সঙ্গী
মনে পড়ে না?
আমরা ছিলাম গাছের ছায়া, ঝড়ের হাওয়ায় ঝড়ের হাওয়া
আমরা ছিলাম দুপুরে রুক্ষ
ছুটি শেষের সমান দুঃখ-
এই দ্যাখো সেই গ্রীবার ক্ষত, এই
যে দ্যাখো চেনা আঙ্গুল
এখনো ভুল???

তোমার চোখ এতো লাল কেন -নির্মলেন্দু গুণ

আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে , আমি চাই
কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক,
শুধু ঘরের ভেতর থেকে দরোজা খুলে দেবার জন্য ।
বাইরে থেকে দরোজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত ।

আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ আমাকে খেতে দিক । আমি হাতপাখা নিয়ে
কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছি না,
আমি জানি, এই ইলেকট্রিকের যুগ
নারীকে মুক্তি দিয়েছে স্বামী -সেবার দায় থেকে ।
আমি চাই কেউ একজন জিজ্ঞেস করুক :
আমার জল লাগবে কি না, নুন লাগবে কি না,
পাটশাক ভাজার সঙ্গে আরও একটা
তেলে ভাজা শুকনো মরিচ লাগবে কি না ।
এঁটো বাসন, গেঞ্জি-রুমাল আমি নিজেই ধুতে পারি ।

আমি বলছি না ভলোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন ভিতর থেকে আমার ঘরের দরোজা
খুলে দিক । কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক ।
কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে
জিজ্ঞেস করুক : 'তোমার চোখ এতো লাল কেন ?'

তুমি ফিরবে- সমরেশ মজুমদার

তুমি ফিরবে কোন একদিন
হয়তো নীলিমায় হারানো কোন এক নিষ্প্রভ
বেলায়।
নতুবা কোন এক নবীন হেমন্তে,
এক নতুন দিনের নির্মল খোলা হাওয়ায়।
অথবা কোন এক শ্রাবণের দিনে
অহরহ ঝরা ঘন কাল মেঘ বৃষ্টির
মুহু মুহু নির্ঝর খেলায়।
তুমি ফিরবে কোন এক রাতে
পূর্ণিমার ভরা জোছনায়।
তুমি ফিরবে জানি বহুদিন পরে
হয়তো বা হাজার বছর পরে।
কোন এক নিঃস্ব হৃদয়ে,
লক্ষ প্রাণের ভিড়ে, তুমি ফিরবে।
বহুরুপে সেই প্রাণে, অনেক নবীনের ভিড়ে,
তোমার আমার গড়া ভালবাসার নীড়ে।





মন ভালো নেই- মহাদেব সাহা

বিষাদ ছুঁয়েছে আজ, মন ভালো নেই,
মন ভালো নেই;
ফাঁকা রাস্তা, শূন্য বারান্দা
সারাদিন ডাকি সাড়া নেই,
একবার ফিরেও চায় না কেউ
পথ ভুল করে চলে যায়,এদিকে আসে না
আমি কি সহস্র বর্ষ এভাবে
তাকিয়ে থাকব শূণ্যতার দিকে?
এই শুন্য ঘরে, এই নির্বাসনে
কতোকাল,আর কতোকাল !
আজ দুঃখ ছুঁয়েছে ঘরবাড়ি,
উদ্যানে উঠেছে ক্যাকটাস -
কেউ নেই, কড়া নাড়ার মতো কেউ নেই,
শুধু শূণ্যতার এই দীর্ঘশাস, এই দীর্ঘ পদধনি।

টেলিফোন ঘোরাতে ঘোরাতে আমি ক্লান্ত
ডাকতে ডাকতে একশেষ;
কেউ ডাক শোনে না, কেউ ফিরে তাকায় না
এই হিমঘরে ভাঙ্গা চেয়ারে একা বসে আছি।

এ কী শাস্তি তুমি আমাকে দিচ্ছো ঈশর,
এভাবে দগ্ধ হওয়ার নাম কি বেঁচে থাকা !
তবু মানুষ বেঁচে থাকতে চায়, আমি বেঁচে থাকতে চাই
আমি ভালোবাসতে চাই, পাগলের মতো
ভালোবাসতে চাই -
এই কি আমার অপরাধ !
আজ বিষাদ ছুঁয়েছে বুক, বিষাদ ছুঁয়েছে বুক
মন ভালো নেই, মন ভালো নেই;
তোমার আসার কথা ছিলো, তোমার যাওয়ার
কথা ছিলো -
আসা-যাওয়ার পথের ধারে
ফুল ফোটানোর কথা ছিলো
সেসব কিছুই হলো না, কিছুই হলো না;
আমার ভেতরে শুধু এক কোটি বছর ধরে অশ্রুপাত
শুধু হাহাকার
শুধু শূণ্যতা, শূণ্যতা ।
তোমার শূণ্য পথের দিকে তাকাতে তাকাতে
দুই চোখ অন্ধ হয়ে গেলো,
সব নদীপথ বন্ধ হলো, তোমার সময় হলো না -
আজ সারাদিন বিষাদপর্ব,সারাদিন তুষারপাত…
মন ভালো নেই, মন ভালো নেই ।

কবি মহাদেব সাহা।

তোমাকে ভুলতে চেয়ে আরো বেশি ভালোবেসে ফেলি- মহাদেব সাহা।

তোমাকে ভুলতে চেয়ে আরো বেশি ভালোবেসে ফেলি
তোমাকে ছাড়াতে গিয়ে আরো বেশি গভীরে জড়াই,
যতোই তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই দূরে
ততোই তোমার হাতে বন্দি হয়ে পড়ি
তোমাকে এড়াতে গেলে এভাবেই আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যাই
এভাবেই সম্পূর্ণ আড়ষ্ট হয়ে পড়ি;
তোমাকে ছাড়াতে গেলে আরো ক্রমশ জড়িয়ে যাই আমি
আমার কিছুই আর করার থাকে না
তুমি এভাবেই বেঁধে ফেলো যদি দূরে যেতে চাই
যদি ডুবে যেতে চাই তুমি দুহাতে জাগাও।
এমন সাধ্য কী আছে তোমার চোখের সামান্য আড়াল হই,
দুই হাত দূরে যাই
যেখানেই যেতে চাই সেখানেই বিছিয়ে রেখেছো ডালপালা,
তোমাকে কি অতিক্রম করা কখনও সম্ভব
তুমি সমুদ্রের চেয়েও সমুদ্র
আকাশের চেয়েও আকাশ তুমি আমার ভেতরে জেগে আছো।
তোমাকে ভুলতে চেয়ে তাই আরো বেশি
ভালোবেসে ফেলি,
তোমাকে ঠেলতে গিয়ে দূরে আরো কাছে টেনে নেই
যতোই তোমার কাছ থেকে আমি দূরে যেতে চাই
ততো মিশে যাই নি:ম্বাসে প্রশ্বাসে,
ততোই তোমার আমি হয়ে পড়ি ছায়ার মতন;
কোনোদিকে যাওয়ার আর একটুও জায়গা থাকে না
তুমিই জড়িয়ে রাখো তোমার কাঁটায়।
তোমাকে ছাড়তে গিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে আরো জড়িয়েছি
তোমাকে ভুলতে গিয়ে আরো ভালোবেসেছি
তোমাকে।









কবি মহাদেব সাহা।






যা চেয়েছি যা পাবো না- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

যা চেয়েছি, যা পাবো না
-কী চাও আমার কাছে ?
-কিছু তো চাইনি আমি ।
-চাওনি তা ঠিক । তবু কেন
এমন ঝড়ের মতো ডাক দাও ?
-জানি না । ওদিকে দ্যাখো
রোদ্দুরে রুপোর মতো জল
তোমার চোখের মতো
দূরবর্তী নৌকো
চর্তুদিকে তোমাকেই দেখা
-সত্যি করে বলো, কবি, কী চাও আমার কাছে ?
-মনে হয় তুমি দেবী…
-আমি দেবী নই ।
-তুমি তো জানো না তুমি কে !
-কে আমি !
-তুমি সরস্বতী, শব্দটির মূল অর্থে
যদিও মানবী, তাই কাছাকাছি পাওয়া
মাঝে মাঝে নারী নামে ডাকি
-হাসি পায় শুনে । যখন যা মনে আসে
তাই বলো, ঠিক নয় ?
-অনেকটা ঠিক । যখন যা মনে আসে-
কেন মনে আসে ?
-কী চাও, বলো তো সত্যি ? কথা ঘুরিয়ো না
-আশীর্বাদ !
-আশীর্বাদ ? আমার, না সত্যি যিনি দেবী
-তুমিই তো সেই ! টেবিলের ঐ পাশে
ফিকে লাল শাড়ি
আঙ্গুলে ছোঁয়ানো থুতনি,
উঠে এসো
আশীর্বাদ দাও, মাথার ওপরে রাখো হাত
আশীর্বাদে আশীর্বাদে আমাকে পাগল করে তোলো
খিমচে ধরো চুল, আমার কপাল
নোখ দিয়ে চিরে দাও
-যথেষ্ট পাগল আছো ! আরও হতে চাও বুঝি ?
-তোমাকে দেখলেই শুধু এরকম, নয়তো কেমন
শান্তশিষ্ট
-না দেখাই ভালো তবে ! তাই নয় ?
-ভালো মন্দ জেনে শুনে যদি এ-জীবন
কাটাতুম
তবে সে-জীবন ছিল শালিকের, দোয়েলের
বনবিড়ালের কিংবা মহাত্মা গান্ধীর
ইরি ধানে, ধানের পোকার যে-জীবন
-যে জীবন মানুষের ?
-আমি কি মানুষ নাকি ? ছিলাম মানুষ বটে
তোমাকে দেখার আগে
-তুমি সোজাসুজি তাকাও চোখের দিকে
অনেকক্ষণ চেয়ে থাকো
পলক পড়ে না
কী দেখো অমন করে ?
-তোমার ভিতরে তুমি, শাড়ি-সজ্জা খুলে ফেললে
তুমি
তারা আড়ালে যে তুমি
-সে কি সত্যি আমি ? না তোমার নিজের কল্পনা
-শোন্ খুকী
-এই মাত্র দেবী বললে-
-একই কথা ! কল্পনা আধার যিনি, তিনি দেবী-
তুই সেই নীরা
তোর কাছে আশীর্বাদ চাই
-সে আর এমন কি শক্ত ? এক্ষুনি তা দিতে পারি
-তোমার অনেক আছে, কণা মাত্র দাও
-কী আছে আমার ? জানি না তো
-তুমি আছো, তুমি আছো, এর চেয়ে বড় সত্য নেই
-সিঁড়ির ওপরে সেই দেখা
তখন তো বলোনি কিছু ?
আমার নিঃসঙ্গ দিন, আমার অবেলা
আমারই নিজস্ব–শৈশবের হাওয়া শুধু জানে

-দেবে কি দুঃখের অংশভাগ ? আমি
ধনী হবো
-আমার তো দুঃখ নেই–দুঃখের চেয়েও
কোনো সুমহান আবিষ্টতা
আমাকে রয়েছে ঘিরে
তার কোনো ভাগ হয় না
আমার কী আছে আর, কী দেবো তোমাকে ?
-তুমি আছো, তুমি আছো, এর চেয়ে বড় সত্য নেই !
তুমি দেবী, ইচ্ছে হয় হাঁটু গেড়ে বসি
মাথায় তোমার করতল, আশীর্বাদ…
তবু সেখানেও শেষ নেই
কবি নয়, মুহূর্তে পুরুষ হয়ে উঠি
অস্থির দু’হাত
দশ আঙুলে আঁকড়ে ধরতে চায়
সিংহিনীর মতো ঐ যে তোমার কোমর
অবোধ শিশুর মতো মুখ ঘষে তোমার শরীরে
যেন কোনো গুপ্ত সংবাদের জন্য ছটফটানি
-পুরুষ দূরত্বে যাও, কবি কাছে এসো
তোমায় কী দিতে পারি ?
-কিছু নয় !
-অভিমান ?
-নাম দাও অভিমান !
-এটা কিন্তু বেশ ! যদি
অসুখের নাম দিই নির্বাসন
না-দেখার নাম দিই অনস্তিত্ব
দূরত্বের নাম দিই অভিমান ?
-কতটুকু দূরত্ব ? কী, মনে পড়ে ?
-কী করে ভাবলে যে ভুলবো ?
-তুমি এই যে বসে আছো, আঙুলে ছোঁয়ানো থুতনি
কপালে পড়েছে চূর্ণ চুল
পাড়ের নক্সায় ঢাকা পা
ওষ্ঠাগ্রে আসন্ন হাসি-
এই দৃশ্যে অমরত্ব
তুমি তো জানো না, নীরা,
আমার মৃত্যুর পরও এই ছবি থেকে যাবে ।
-সময় কি থেমে থাকবে ? কী চাও আমার কাছে ?
-মৃত্যু ?
-ছিঃ , বলতে নেই
-তবে স্নেহ ? আমি বড় স্নেহের কাঙাল
-পাওনি কি ?
-বুঝতে পারি না ঠিক । বয়স্ক পুরুষ যদি স্নেহ চায়
শরীরও সে চায়
তার গালে গাল চেপে দিতে পারো মধুর উত্তাপ ?
-ফের পাগলামি ?
-দেখা দাও ।
-আমিও তোমায় দেখতে চাই ।
-না !
-কেন ?
-বোলো না । কক্ষনো বোলো না আর এ কথা
আমি ভয় পাবো ।
এ শুধুই এক দিকের
আমি কে ? সামান্য, অতি নগণ্য, কেউ না
তুবি এত স্পর্ধা করে তোমার রূপের কাছে–
-তুমি কবি ?
-তা কি মনে থাকে ? বারবার ভুলে যাই
অবুঝ পুরুষ হয়ে কৃপাপ্রার্থী
-কী চাও আমার কাছে ?
-কিছু নয় । আমার দু’চোখে যদি ধুলো পড়ে
আঁচলের ভাপ দিয়ে মুছে দেবে ?

এই জীবন- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

বাঁচতে হবে বাঁচার মতন, বাঁচতে-বাঁচতে
এই জীবনটা গোটা একটা জীবন হয়ে
জীবন্ত হোক
আমি কিছুই ছাড়বো না, এই রোদ ও বৃষ্টি
আমাকে দাও ক্ষুধার অন্ন
শুধু যা নয় নিছক অন্ন
আমার চাই সব লাবণ্য
নইলে গোটা দুনিয়া খাবো!
আমাকে কেউ গ্রামে গঞ্জে ভিখারী করে
পালিয়ে যাবে?
আমায় কেউ নিলাম করবে সুতো কলে
কামারশালায়?
আমি কিছুই ছাড়বো না আর, এখন আমার
অন্য খেলা
পদ্মপাতায় ফড়িং যেমন আপনমনে খেলায় মাতে
গোটা জীবন
মানুষ সেজে আসা হলো,
মানুষ হয়েই ফিরে যাবো
বাঁচতে হবে বাঁচার মতন,বাঁচতে-বাঁচতে
এই জীবনটা গোটা একটা জীবন হয়ে
জীবন্ত হোক!

আমি কিংবদন্তির কথা বলছি- আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ

আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল।
তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন
অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন
পতিত জমি আবাদের কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা,
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।
আমি উচ্চারিত সত্যের মতো
স্বপ্নের কথা বলছি।
উনুনের আগুনে আলোকিত
একটি উজ্জ্বল জানালার কথা বলছি।
আমি আমার মা’য়ের কথা বলছি,
তিনি বলতেন প্রবহমান নদী
যে সাতার জানে না তাকেও ভাসিয়ে রাখে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে নদীতে ভাসতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মাছের সঙ্গে খেলা করতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মা’য়ের কোলে শুয়ে গল্প শুনতে পারে না
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি বিচলিত স্নেহের কথা বলছি
গর্ভবতী বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলছি।
ভালোবাসা দিলে মা মরে যায়
যুদ্ধ আসে ভালোবেসে
মা’য়ের ছেলেরা চলে যায়,
আমি আমার ভাইয়ের কথা বলছি।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সন্তানের জন্য মরতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ভালোবেসে যুদ্ধে যেতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সূর্যকে হৃদপিন্ডে ধরে রাখতে পারে না।
আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল
কারণ তিনি ক্রীতদাস ছিলেন।
আমরা কি তা’র মতো কবিতার কথা বলতে পারবো,
আমরা কি তা’র মতো স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো!
তিনি মৃত্তিকার গভীরে
কর্ষণের কথা বলতেন
অবগাহিত ক্ষেত্রে
পরিচ্ছন্ন বীজ বপনের কথা বলতেন
সবত্সা গাভীর মত
দুগ্ধবতী শস্যের পরিচর্যার কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।
যে কর্ষণ করে তাঁর প্রতিটি স্বেদবিন্দু কবিতা
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
শস্যহীন প্রান্তর তাকে পরিহাস করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মাতৃস্তন্য থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্ষুধার্ত থেকে যাবে।
যখন প্রবঞ্চক ভূস্বামীর প্রচন্ড দাবদাহ
আমাদের শস্যকে বিপর্যস্ত করলো
তখন আমরা শ্রাবণের মেঘের মত
যূথবদ্ধ হলাম।
বর্ষণের স্নিগ্ধ প্রলেপে
মৃত মৃত্তিকাকে সঞ্জীবিত করলাম।
বারিসিক্ত ভূমিতে
পরিচ্ছন্ন বীজ বপন করলাম।
সুগঠিত স্বেদবিন্দুর মত
শস্যের সৌকর্য অবলোকন করলাম,
এবং এক অবিশ্বাস্য আঘ্রাণ
আনিঃশ্বাস গ্রহণ করলাম।
তখন বিষসর্প প্রভুগণ
অন্ধকার গহ্বরে প্রবেশ করলো
এবং আমরা ঘন সন্নিবিষ্ট তাম্রলিপির মত
রৌদ্রালোকে উদ্ভাসিত হলাম।
তখন আমরা সমবেত কন্ঠে
কবিতাকে ধারণ করলাম।
দিগন্ত বিদীর্ণ করা বজ্রের উদ্ভাসন কবিতা
রক্তজবার মত প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
পরভৃতের গ্লানি তাকে ভূলুন্ঠিত করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
অভ্যূত্থানের জলোচ্ছ্বাস তাকে নতজানু করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
পলিমাটির সৌরভ তাকে পরিত্যাগ করবে।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তিনি স্বপ্নের মত সত্য ভাষণের কথা বলতেন
সুপ্রাচীন সংগীতের আশ্চর্য ব্যাপ্তির কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।
যখন কবিকে হত্যা করা হল
তখন আমরা নদী এবং সমুদ্রের মোহনার মত
সৌভ্রত্রে সম্মিলিত হলাম।
প্রজ্জ্বলিত সূর্যের মত অগ্নিগর্ভ হলাম।
ক্ষিপ্রগতি বিদ্যুতের মত
ত্রিভূবন পরিভ্রমণ করলাম।
এবং হিংস্র ঘাতক নতজানু হয়ে
কবিতার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলো।
তখন আমরা দুঃখকে ক্রোধ
এবং ক্রোধকে আনন্দিত করলাম।
নদী এবং সমুদ্রে মোহনার মত
সম্মিলিত কন্ঠস্বর কবিতা
অবদমিত ক্রোধের আনন্দিত উত্সারণ কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে তরঙ্গের সৌহার্দ থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
নিঃসঙ্গ বিষাদ তাকে অভিশপ্ত করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মূক ও বধির থেকে যাবে।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল
আমি একগুচ্ছ রক্তজবার কথা বলছি।
আমি জলোচ্ছ্বাসের মত
অভ্যূত্থানের কথা বলছি
উত্ক্ষিপ্ত নক্ষত্রের মত
কমলের চোখের কথা বলছি
প্রস্ফুটিত পুষ্পের মত
সহস্র ক্ষতের কথা বলছি
আমি নিরুদ্দিষ্ট সন্তানের জননীর কথা বলছি
আমি বহ্নমান মৃত্যু
এবং স্বাধীনতার কথা বলছি।
যখন রাজশক্তি আমাদের আঘাত করলো
তখন আমরা প্রাচীণ সংগীতের মত
ঋজু এবং সংহত হলাম।
পর্বত শৃংগের মত
মহাকাশকে স্পর্শ করলাম।
দিকচক্রবালের মত
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলাম;
এবং শ্বেত সন্ত্রাসকে
সমূলে উত্পাটিত করলাম।
তখন আমরা নক্ষত্রপুঞ্জের মত
উজ্জ্বল এবং প্রশান্ত হলাম।
উত্ক্ষিপ্ত নক্ষত্রের প্রস্ফুটিত ক্ষতচিহ্ন কবিতা
স্পর্ধিত মধ্যাহ্নের আলোকিত উম্মোচন কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে নীলিমাকে স্পর্শ করতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মধ্যাহ্নের প্রত্যয়ে প্রদীপ্ত হতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সন্ত্রাসের প্রতিহত করতে পারে না।
আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি শ্রমজীবী মানুষের
উদ্বেল অভিযাত্রার কথা বলছি
আদিবাস অরণ্যের
অনার্য সংহতির কথা বলছি
শৃংখলিত বৃক্ষের
উর্দ্ধমুখী অহংকারের কথা বলছি,
আমি অতীত এবং সমকালের কথা বলছি।
শৃংখলিত বৃক্ষের উর্দ্ধমুখী অহংকার কবিতা
আদিবাস অরণ্যের অনার্য সংহতি কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
যূথভ্রষ্ট বিশৃংখলা তাকে বিপর্যস্ত করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
বিভ্রান্ত অবক্ষয় তাকে দৃষ্টিহীন করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম হীনমন্য থেকে যাবে।
যখন আমরা নগরীতে প্রবেশ করলাম
তখন চতুর্দিকে ক্ষুধা।
নিঃসঙ্গ মৃত্তিকা শস্যহীন
ফলবতী বৃক্ষরাজি নিস্ফল
এবং ভাসমান ভূখন্ডের মত
ছিন্নমূল মানুষেরা ক্ষুধার্ত।
যখন আমরা নগরীতে প্রবেশ করলাম
তখন আদিগন্ত বিশৃংখলা।
নিরুদ্দিষ্ট সন্তানের জননী শোকসন্তপ্ত
দীর্ঘদেহ পুত্রগণ বিভ্রান্ত
এবং রক্তবর্ণ কমলের মত
বিস্ফোরিত নেত্র দৃষ্টিহীন।
তখন আমরা পূর্বপুরুষকে
স্মরণ করলাম।
প্রপিতামহের বীর গাঁথা
স্মরণ করলাম।
আদিবাসী অরণ্য এবং নতজানু শ্বাপদের কথা
স্মরণ করলাম।
তখন আমরা পর্বতের মত অবিচল
এবং ধ্রুবনক্ষত্রের মত স্থির লক্ষ্য হলাম।
আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি স্থির লক্ষ্য মানুষের
সশস্ত্র অভ্যুত্থানের কথা বলছি
শ্রেণীযুদ্ধের অলিন্দে
ইতিহাসের বিচরণের কথা বলছি
আমি ইতিহাস এবং স্বপ্নের কথা বলছি।
স্বপ্নের মত সত্যভাষণ ইতিহাস
ইতিহাসের আনন্দিত অভিজ্ঞান কবিতা
যে বিনিদ্র সে স্বপ্ন দেখতে পারে না
যে অসুখী সে কবিতা লিখতে পারে না।
যে উদ্গত অংকুরের মত আনন্দিত
সে কবি
যে সত্যের মত স্বপ্নভাবী
সে কবি
যখন মানুষ মানুষকে ভালবাসবে
তখন প্রত্যেকে কবি।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি বিচলিত বর্তমান
এবং অন্তিম সংগ্রামের কথা বলছি।
খন্ডযুদ্ধের বিরতিতে
আমরা ভূমি কর্ষণ করেছি।
হত্যা এবং ঘাতকের সংকীর্ণ ছায়াপথে
পরিচ্ছন্ন বীজ বপন করেছি।
এবং প্রবহমান নদীর সুকুমার দাক্ষিণ্যে
শস্যের পরিচর্যা করছি।
আমাদের মুখাবয়ব অসুন্দর
কারণ বিকৃতির প্রতি ঘৃণা
মানুষকে কুশ্রী করে দ্যায়।
আমাদের কণ্ঠস্বর রূঢ়
কারণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ
কণ্ঠকে কর্কশ করে তোলে।
আমাদের পৃষ্ঠদেশে নাক্ষত্রিক ক্ষতচিহ্ন
কারণ উচ্চারিত শব্দ আশ্চর্য বিশ্বাসঘাতক
আমাদেরকে বারবার বধ্যভূমিতে উপনীত করেছে।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমার সন্তানেরা
আমি তোমাদের বলছি।
যেদিন প্রতিটি উচ্চারিত শব্দ
সূর্যের মত সত্য হবে
সেই ভবিষ্যতের কথা বলছি,
সেই ভবিষ্যতের কবিতার কথা বলছি।
আমি বিষসর্প প্রভুদের
চির প্রয়াণের কথা বলছি
দ্বন্দ্ব এবং বিরোধের
পরিসমাপ্তির কথা বলছি
সুতীব্র ঘৃণার
চূড়ান্ত অবসানের কথা বলছি।
আমি সুপুরুষ ভালবাসার
সুকণ্ঠ সংগীতের কথা বলছি।
যে কর্ষণ করে
শস্যের সম্ভার তাকে সমৃদ্ধ করবে।
যে মত্স্য লালন করে
প্রবহমান নদী তাকে পুরস্কৃত করবে।
যে গাভীর পরিচর্যা করে
জননীর আশীর্বাদ তাকে দীর্ঘায়ু করবে।
যে লৌহখন্ডকে প্রজ্জ্বলিত করে
ইস্পাতের তরবারি তাকে সশস্ত্র করবে।
দীর্ঘদেহ পুত্রগণ
আমি তোমাদের বলছি।
আমি আমার মায়ের কথা বলছি
বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
ভাইয়ের যুদ্ধের কথা বলছি
আমি আমার ভালবাসার কথা বলছি।
আমি কবি এবং কবিতার কথা বলছি।
সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা
সুপুরুষ ভালবাসার সুকণ্ঠ সংগীত কবিতা
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দ কবিতা
রক্তজবার মতো প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।
আমরা কি তাঁর মত কবিতার কথা বলতে পারবো
আমরা কি তাঁর মত স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো ?

তবু তোমার অপেক্ষায় থাকবো

হাই তোলা কোণ এক ভরদুপুরে
একটি নিঃসঙ্গ কালো কাকের সাথে
কোণ এক কৃষ্ণচূড়ার ডালে
আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো।

চোখ ধাধানো কোণ এক জ্যোৎস্না রাতে
একাকি নদীর পাড়ে
জলের গোপন সুরের অতন্দ্র মোহে
আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো।

শিশির ভেজা কোণ এক হিম সকালে
ধু ধু তেপান্তরে
সিক্ত ঘাস ফুলের সাথে
আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো।

যদি কালো কাক উড়ে যায়
যদি জলের গোপন সুর থেমে যায়
যদি ঘাস ফুল না ফোটে
তবু তোমার অপেক্ষায় থাকবো।

বৃহস্পতিবার, ১২ জুন, ২০১৪

আমি দেখেও চোখ ফিরিয়ে নেবো!

আমার কাছে এক টুকরো রোদ আছে
ঘুনে খাওয়া টেবিলে ছোট্ট শিশিতে রেখেছি
প্রতিদিন রাতে আসা জোনাকি পোকাটা বেশ রেগে আছে
আমি দেখেও চোখ ফিরিয়ে নেই।

ঘুন পোকাটা কাঠ কাটার অবসরে উঁকি দিয়ে দেখে যায়
সে ও মনে হয় আমার মতোই উপভোগ করছে
ঘুলঘুলিতে বাসা বাধা চড়ুইটা প্রতি রাতেই ধোঁকা খায়
আমি দেখেও চোখ ফিরিয়ে নেই।

রোদের টুকরো প্রায় চেষ্টা করে বেরিয়ে আসার
আমি শিশির মুখটা শক্ত করে এটে দেই
বেশ করুন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে
আমি দেখেও চোখ ফিরিয়ে নেই।

ভাবছি এবার এক খণ্ড মেঘ ধরে আনবো
মাঝে মাঝে রোদকে মেঘ দিয়ে ঢেকে দেবো
জোনাকি পোকাটা হয়তো তখন খুব খুশি হবে
আমি দেখেও চোখ ফিরিয়ে নেবো।

১২.০৬.২০১৪

বুধবার, ১৪ মে, ২০১৪

দারিদ্র্য- কাজী নজরুল ইসলাম।

হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান্।
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান
কন্টক-মুকুট শোভা।-দিয়াছ, তাপস,
অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;
উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার,
বীণা মোর শাপে তব হ’ল তরবার!
দুঃসহ দাহনে তব হে দর্পী তাপস,
অম্লান স্বর্ণেরে মোর করিলে বিরস,
অকালে শুকালে মোর রূপ রস প্রাণ!
শীর্ণ করপুট ভরি’ সুন্দরের দান
যতবার নিতে যাই-হে বুভুক্ষু তুমি
অগ্রে আসি’ কর পান! শূন্য মরুভূমি
হেরি মম কল্পলোক। আমার নয়ন
আমারি সুন্দরে করে অগ্নি বরিষণ!
বেদনা-হলুদ-বৃন্ত কামনা আমার
শেফালির মত শুভ্র সুরভি-বিথার
বিকশি’ উঠিতে চাহে, তুমি হে নির্মম,
দলবৃন্ত ভাঙ শাখা কাঠুরিয়া সম!
আশ্বিনের প্রভাতের মত ছলছল
ক’রে ওঠে সারা হিয়া, শিশির সজল

টলটল ধরণীর মত করুণায়!
তুমি রবি, তব তাপে শুকাইয়া যায়
করুণা-নীহার-বিন্দু! ম্লান হ’য়ে উঠি
ধরণীর ছায়াঞ্চলে! স্বপ্ন যায় টুটি’
সুন্দরের, কল্যাণের। তরল গরল
কন্ঠে ঢালি’ তুমি বল, ‘অমৃতে কি ফল?
জ্বালা নাই, নেশা নাই. নাই উন্মাদনা,-
রে দুর্বল, অমরার অমৃত-সাধনা
এ দুঃখের পৃথিবীতে তোর ব্রত নহে,
তুই নাগ, জন্ম তোর বেদনার দহে।
কাঁটা-কুঞ্জে বসি’ তুই গাঁথিবি মালিকা,
দিয়া গেনু ভালে তোর বেদনার টিকা!….
গাহি গান, গাঁথি মালা, কন্ঠ করে জ্বালা,
দংশিল সর্বাঙ্গে মোর নাগ-নাগবালা!….

ভিক্ষা-ঝুলি নিয়া ফের’ দ্বারে দ্বারে ঋষি
ক্ষমাহীন হে দুর্বাসা! যাপিতেছে নিশি
সুখে রব-বধূ যথা-সেখানে কখন,
হে কঠোর-কন্ঠ, গিয়া ডাক-‘মূঢ়, শোন্,
ধরণী বিলাস-কুঞ্জ নহে নহে কারো,
অভাব বিরহ আছে, আছে দুঃখ আরো,
আছে কাঁটা শয্যাতলে বাহুতে প্রিয়ার,
তাই এবে কর্ ভোগ!-পড়ে হাহাকার
নিমেষে সে সুখ-স্বর্গে, নিবে যায় বাতি,
কাটিতে চাহে না যেন আর কাল-রাতি!
চল-পথে অনশন-ক্লিষ্ট ক্ষীণ তনু,
কী দেখি’ বাঁকিয়া ওঠে সহসা ভ্রূ-ধনু,
দু’নয়ন ভরি’ রুদ্র হানো অগ্নি-বাণ,
আসে রাজ্যে মহামারী দুর্ভিক্ষ তুফান,
প্রমোদ-কানন পুড়ে, উড়ে অট্টালিকা,-
তোমার আইনে শুধু মৃত্যু-দন্ড লিখা!
বিনয়ের ব্যভিচার নাহি তব পাশ,
তুমি চান নগ্নতার উলঙ্গ প্রকাশ।
সঙ্কোচ শরম বলি’ জান না ক’ কিছু,
উন্নত করিছ শির যার মাথা নীচু।
মৃত্যু-পথ-যাত্রীদল তোমার ইঙ্গিতে
গলায় পরিছে ফাঁসি হাসিতে হাসিতে!
নিত্য অভাবের কুন্ড জ্বালাইয়া বুকে
সাধিতেছ মৃত্যু-যজ্ঞ পৈশাচিক সুখে!
লক্ষ্মীর কিরীটি ধরি, ফেলিতেছ টানি’
ধূলিতলে। বীণা-তারে করাঘাত হানি’
সারদার, কী সুর বাজাতে চাহ গুণী?
যত সুর আর্তনাদ হ’য়ে ওঠে শুনি!
প্রভাতে উঠিয়া কালি শুনিনু, সানাই
বাজিছে করুণ সুরে! যেন আসে নাই
আজো কা’রা ঘরে ফিরে! কাঁদিয়া কাঁদিয়া
ডাকিছে তাদেরে যেন ঘরে ‘সানাইয়া’!
বধূদের প্রাণ আজ সানা’য়ের সুরে
ভেসে যায় যথা আজ প্রিয়তম দূরে
আসি আসি করিতেছে! সখী বলে, ‘বল্
মুছিলি কেন লা আঁখি, মুছিলি কাজল?….

শুনিতেছি আজো আমি প্রাতে উঠিয়াই
‘ আয় আয়’ কাঁদিতেছে তেমনি সানাই।
ম্লানমুখী শেফালিকা পড়িতেছে ঝরি’
বিধবার হাসি সম-স্নিগ্ধ গন্ধে ভরি’!
নেচে ফেরে প্রজাপতি চঞ্চল পাখায়
দুরন্ত নেশায় আজি, পুষ্প-প্রগল্ভায়
চুম্বনে বিবশ করি’! ভোমোরার পাখা
পরাগে হলুদ আজি, অঙ্গে মধু মাখা।

উছলি’ উঠিছে যেন দিকে দিকে প্রাণ!
আপনার অগোচরে গেয়ে উঠি গান
আগমনী আনন্দের! অকারণে আঁখি
পু’রে আসে অশ্রু-জলে! মিলনের রাখী
কে যেন বাঁধিয়া দেয় ধরণীর সাথে!
পুষ্পঞ্জলি ভরি’ দু’টি মাটি মাখা হাতে
ধরণী এগিয়ে আসে, দেয় উপহার।
ও যেন কনিষ্ঠা মেয়ে দুলালী আমার!-
সহসা চমকি’ উঠি! হায় মোর শিশু
জাগিয়া কাঁদিছ ঘরে, খাওনি ক’ কিছু
কালি হ’তে সারাদিন তাপস নিষ্ঠুর,
কাঁদ’ মোর ঘরে নিত্য তুমি ক্ষুধাতুর!

পারি নাই বাছা মোর, হে প্রিয় আমার,
দুই বিন্দু দুগ্ধ দিতে!-মোর অধিকার
আনন্দের নাহি নাহি! দারিদ্র্য অসহ
পুত্র হ’য়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ
আমার দুয়ার ধরি! কে বাজাবে বাঁশি?
কোথা পাব আনন্দিত সুন্দরের হাসি?
কোথা পাব পুষ্পাসব?-ধুতুরা-গেলাস
ভরিয়া করেছি পান নয়ন-নির্যাস!….
আজো শুনি আগমনী গাহিছে সানাই,
ও যেন কাঁদিছে শুধু-নাই কিছু নাই!

বিদ্রোহী- কাজী নজরুল ইসলাম।

        বল বীর-
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারী' আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রীর!
বল বীর-
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি'
চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি'
ভূলোক দ্যূলোক গোলোক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর-
আমি চির-উন্নত শির! আমি চিরদুর্দম, দূর্বিনীত, নৃশংস,
মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
আমি দূর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি না কো কোন আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর!
বল বীর-
চির-উন্নত মম শির! আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি,
আমি পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’।
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’
পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’
ফিং দিয়া দেই তিন দোল্‌;
আমি চপোলা-চপোল হিন্দোল।
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা’,
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা,
আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা!
আমি মহামারী, আমি ভীতি এ ধরীত্রির;
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির অধীর।
বল বীর-
আমি চির-উন্নত শির! আমি চির-দূরন্ত দুর্মদ
আমি দূর্দম মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম্‌ হ্যায় হর্দম্‌ ভরপুর্‌ মদ। আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান। আমি ঈন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ তূর্য; আমি কৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির।
আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
বল বীর-
চির-উন্নত মম শির! আমি সন্ন্যাসী, সুর সৈনিক,
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক।
আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কূর্ণিশ।
আমি বজ্র, আমি ঈষাণ-বিষানে ওঙ্কার,
আমি ইস্রাফিলের শৃঙ্গার মহা-হুঙ্কার,
আমি পিনাক-পাণির ডমরু ত্রিশুল, ধর্মরাজের দন্ড,
আমি চক্র-মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড!
আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি দাবানল-দাহ, দহন করিব বিশ্ব।
আমি প্রাণ-খোলা হাসি উল্লাস, -আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস
আমি মহাপ্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস!
আমি কভু প্রশান্ত, -কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী!
আমি প্রভঞ্জনের উচ্ছাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল,
আমি উজ্জ্বল, আমি প্রোজ্জ্বল,
আমি উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল ঊর্মির হিন্দোল-দোল!- আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেনী, তন্বী নয়নে বহ্নি,
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি! আমি উন্মন, মন-উদাসীর,
আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর।
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয় লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের
আমি অভিমানী চির ক্ষূব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যাথা সূনিবিড়,
চিত চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর থর থর প্রথম পরশ কুমারীর!
আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক’রে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তাঁর কাঁকণ-চুড়ির কন্‌-কন্‌।
আমি চির শিশু, চির কিশোর,
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচুলি নিচোর!
আমি উত্তর-বায়ু মলয়-অনিল উদাস পূরবী হাওয়া,
আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া।
আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি
আমি মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়াছবি!
আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি, এ কি উন্মাদ আমি উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ! আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন চিতে চেতন,
আমি বিশ্বতোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন।
ছুটি ঝড়ের মতন করতালী দিয়া
স্বর্গ মর্ত্য-করতলে,
তাজী বোর্‌রাক্‌ আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার
হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে! আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রী, বাড়ব বহ্নি, কালানল,
আমি পাতালে মাতাল, অগ্নি-পাথার-কলরোল-কল-কোলাহল!
আমি তড়িতে চড়িয়া, উড়ে চলি জোড় তুড়ি দিয়া দিয়া লম্ফ,
আমি ত্রাস সঞ্চারি’ ভুবনে সহসা, সঞ্চারি ভূমিকম্প। ধরি বাসুকির ফণা জাপটি’-
ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি’। আমি দেবশিশু, আমি চঞ্চল,
আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল!
আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
মহা-সিন্ধু উতলা ঘুম্‌ঘুম্‌
ঘুম্‌ চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্‌ঝুম
মম বাঁশরীর তানে পাশরি’।
আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী। আমি রুষে উঠে যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোযখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া! আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা,
কভু ধরনীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস ধন্যা-
আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি ধূমকেতু জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী!
আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি! আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়!
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,
জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি স্বর্গ-পাতাল মর্ত্য!
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!! আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার,
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!
আমি হল বলরাম স্কন্ধে,
আমি উপাড়ি' ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে। মহা- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না -
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি আমি সেই দিন হব শান্ত!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব-ভিন্ন!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন! আমি চির-বিদ্রোহী বীর -
আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!

শুক্রবার, ৯ মে, ২০১৪

পথিকের আত্নকথা

হাঁটছি আমি
অনন্ত পথ
অনেক দিন
পথের মাঝে
স্বপন দেখে
হই রঙ্গিন
ভাবছি শুধু
হাঁটতে থাকি
আপন মনে
ছোট ছোট
স্বপ্ন আঁকা
পথের বাঁকে
ছুঁয়ে দিলেই
মিলিয়ে যায়
হাওয়ার মাঝে
ঘোরের টানে
স্বপন সাজাই
নিজের মত
হাওয়ার সনে
যুদ্ধ চলে,
অবিরাম-অবিরত
লুকিয়ে রাখা
দুঃখ সকল
আছে যত
মনের ক্ষত
তবু হাসি
স্বপ্ন দেখি
আপন আলোয়
আপন মনে
পথগুলো আজ,
চলছে ছুটে
পথের টানে
সময় ঘোড়া,
ছুটছে বুঝি
সময় পানে
আমি পথিক
চলছি শুধু
ভুল পথে
শুদ্ধ পথ
খুঁজছি আজ
উলটো রথে।।

**বিষন্নতা একটি রোগ। চিকিৎসা বিজ্ঞানে বলা হয়েছে। যেকোনো সময়, যেকোনো বয়সে এটা হতে পারে। আমি সময় ও বয়সের মাঝেই বসবাস করি। সুতরাং...!

রাশেদুজ্জামান রন।
০৯.০৫.২০১৪ 

শনিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৪

বৃষ্টি কথা বলো- রাশেদুজ্জামান রন।

আমি ছুট্টি দিলাম তোমাদের
কষ্টের ছটায় আর ভেঙ্গে পড়তে হবেনা
ক্যানো কুড়োবে বাষ্পীয় ভালবাসা
গুমোট ভাব ভুলে মেতে ওঠো
হিমেল হাওয়াকে ডেকোনা
থাকি কিছুদিন ছন্নছাড়া
চলো ঘুরতে যাই মাসি-পিসির বাড়ী
কিংবা আড্ডাবাজ বন্ধুকে দেখে আসি
খুঁজুক তারা, ডাকুক দেখি...!


হন্যে হয়ে খুঁজছি শীতল বিবিকে
গাছ-গাছালী খুঁজছে তাকে
পাখ-পাখালী অস্থির তার জন্যে
তার চেয়েও বেশি চায় আদম পাখি
ভালবাসা নয়, শারীরিক চাহিদা

না বুঝে কষ্ট দিয়েছি অনেক
বুঝে দিয়েছি তার চেয়েও বেশি
অভিমানী চোখের জল শুকিয়েছে
কথা নেই মুখে
শুধু পালিয়ে বেড়ানো

তোমাদের ছুটি, শেষ কবে,
বলে যাও প্রিয়!
ফিরে এসো, সূর্যকে দাও ছুট্টি!

২৬.০৪.১৪

বুধবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৪

চিঠি দিও -মহাদেব সাহা

করুণা করে হলেও চিঠি দিও,
খামে ভরে তুলে দিও
আঙ্গুলের মিহিন সেলাই।

ভুল বানানেও লিখো প্রিয়,
বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,
এটুকু সামান্য দাবি, চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো
অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।

চুলের মতন কোনো চিহ্ন দিও বিস্ময় বোঝাতে যদি চাও...
বর্ণণা আলস্য লাগে তোমার চোখের মতো চিহ্ন কিছু দিও!

আজো তো অমল আমি চিঠি চাই, পথ চেয়ে আছি,
আসবেন অচেনা রাজার লোক
তার হাতে চিঠি দিও,
বাড়ি পৌঁছে দেবে....

এমন ব্যস্ততা যদি শুদ্ধ করে একটি শব্দই শুধু লিখো, তোমার কুশল!...

করুণা করে হলেও চিঠি দিও,
ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি
দিও খামে।
কিছুই লেখার নেই তবু
লিখো একটি পাখির শিস
একটি ফুলের ছোট নাম,
টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে কিছু,
হয়তো পাওনি খুঁজে
সেইসব চুপচাপ কোন দুপুরবেলার গল্প
খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড় একা লাগে, তাই লিখো।

করুণা করে হলেও চিঠি দিও,
মিথ্যা করে হলেও বোলো, ভালবাসি!

আমি খুব অল্প কিছু চাই ! -হুমায়ুন আহমেদ

আমাকে ভালবাসতে হবে না,
ভালবাসি বলতে হবে না.
মাঝে মাঝে গভীর আবেগ
নিয়ে আমার ঠোঁট
দুটো ছুয়ে দিতে হবে না.
কিংবা আমার জন্য রাত
জাগা পাখিও
হতে হবে না.
অন্য সবার মত আমার
সাথে রুটিন মেনে দেখা
করতে হবে না. কিংবা বিকেল বেলায় ফুচকাও
খেতে হবে না. এত
অসীম সংখ্যক “না”এর ভিড়ে
শুধু মাত্র একটা কাজ
করতে হবে আমি যখন
প্রতিদিন এক বার “ভালবাসি” বলব
তুমি প্রতিবার
একটা দীর্ঘশ্বাস
ফেলে একটু
খানি আদর মাখা
গলায় বলবে “পাগলি”

বিশ্বাস কর !

দুঃখপোষা মেয়ে -তসলিমা নাসরিন

কান্না রেখে একটুখানি বস
দুঃখ-ঝোলা একেক করে খোল...
দেখাও তোমার গোপন ক্ষতগুলো
এ ক'দিনে গভীর কতো হল।

ও মেয়ে, শুনছ !

বাইরে খানিক মেলে দাও তো এসব
দুঃখ তোমার একদম গেছে ভিজে...
হাওয়ার একটি গুণ চমৎকার
কিছু দুঃখ উড়িয়ে নেয় নিজে।

ও কী গুণছ !
দিন!

দিন তো যাবেই ! দুঃখপোষা মেয়ে !
শুকোতে দাও স্যাঁতস্যাঁতে এ জীবন
রোদের পিঠে, আলোর বিষম বন্যা
হচ্ছে দেখ, নাচছে ঘন বন...
সঙ্গে সুখী হরিণ।

ও মেয়ে হাসো,
নিজের দিকে দু'চোখ দাও,
নিজেকে ভালোবাসো।

খেলাঘর –নির্মলেন্দু গুণ

শিশুরা খেলাঘর করে ।
তারা হাঁড়ি-পাতিল, বাসন-কোসন নিয়ে
বড়দের মতো সংসার সংসার খেলে ।
তারপর একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে
ঘুমভাঙ্গার পর শুরু হয় তাদের অন্যখেলা ।
এক্কা-দোক্কা, গোল্লাছুট কিংবা
কানামাছি ভোঁ ভোঁ !

বড়োরাও খেলাঘর করে ।
তাদের বাসন-কোসনগুলো আকৃতিতে বড়ো,
তাদের কামনা বাসনার মতো ।
তারা তাদের খেলাঘরের নাম রাখে সংসার ।
শিশুদের মতো তারাও ক্লান্ত হয় ,
তারাও সংসার ভাঙ্গে, কিন্তু শিশুদের মতো
তারা ঘুমুতে পারে না ।

অমীমাংসিত সন্ধি- হেলাল হাফিজ

তোমাকে শুধু তোমাকে চাই, পাবো ?
পাই বা না পাই এক জীবনে তোমার কাছেই যাবো ।

ইচ্ছে হলে দেখতে দিয়ো, দেখো
হাত বাড়িয়ে হাত চেয়েছি রাখতে দিয়ো, রেখো ।

অপূর্ণতায় নষ্টে কষ্টে গেলো
এতোটা কাল, আজকে যদি মাতাল জোয়ার এলো
এসো দু’জন প্লাবিত হই প্রেমে
নিরাভরণ সখ্য হবে যুগল-স্নানে নেমে ।

থাকবো ব্যাকুল শর্তবিহীন নত
পরস্পরের বুকের কাছে মুগ্ধ অভিভূত ।

নাগরিক ভালবাসা- রাশেদুজ্জামান রন।

যে তোমার সাথে কথা বলতাম, ঘন্টার পর ঘন্টা
কারণে আর অকারণে
কথা শেষ হতে না হতেই ভাবতাম
কি যেনো বলা হলোনা!
আবার ডায়াল করার সাথেই
ফোনটা বেজে উঠতো বিরক্তি সহকারে
তোমার আনন্দের কাছে তা ছিল
অতি গৌণ!


সেই তুমি আজো আছো
একই শহরে, পাশাপাশি
তোমাকে ভাবতে গেলেই
কারণ খুঁজতে হয়
অকারণে সেলফোন থাকে বহুদুরে
কী বলবো, সাজাতে হয় মনে মনে
তোমার দেয়া সুনীল, সঞ্জীব
আজ ধুলোয় মাখামাখি
হুমায়ুন পড়ে আছে বড় অযতনে
শুধু র‍্যাপিং পেপারে মোড়ানো
আমাদের ভালবাসা
সেই আগের মতোই দোলা দিয়ে যায়!


২৩.০৪.২০১৪

রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৪

অদৃশ্য ভালবাসা- রাশেদুজ্জামান রন।

সে এসেছিল,
চলে গিয়েছে
তার চলে যাওয়াতে
আমি খুশি হয়েছি!
কথা দিয়েছে,
এক গাল হাসি-আনন্দ নিয়ে
আবার আসিবে ফিরে...!
আমি কি তার জন্য অপেক্ষায় থাকবো

যদি সে না আসে আর
কিংবা আলোর রোশনাইয়ে পথ হারায়
অথবা অজানার দেশে থেকে যায় অনন্ত কাল
হয়তো ফেরা হলোনা কোনোদিন
আবার এমনও তো হতে পারে
সে চেয়েছে কেউ অপেক্ষায় থাকুক...!
এমন অনেক কিছুই মনের মাঝে উঁকি দিয়ে যায়
দোলাচলে দোলে দেহ-মন।
সন্দেহ নেই, তাকে ভালবাসি
কিন্তু কেন, তা জানিনা
এই না জানাই হতে পারে সব প্রশ্নের উত্তর!

তবুও অপেক্ষায় থাকবো
হোকনা যতই ক্ষতি
থমকে গেলেও আপত্তি নাই!

সখী ভালবাসা কারে কয়
কষ্ট কষ্ট সুখের অসুখ
ধীরে ধীরে ক্ষয়!


২০.০৪.২০১৪

বুধবার, ২ এপ্রিল, ২০১৪

দাগ টেনে যায়- রাশেদুজ্জামান রন।

বলি রেখা,
তুমি কেমন আছো, বয়সের ভারে কি নূজ্ব হয়ে পড়েছো

করুণ হাসি তোমার ঠোঁটে একদম মানাচ্ছেনা!
কপাল হতে কপোলে এসেছো, তবুও পথচলা শেষ হয়নি,
সমস্ত তনু জড়িয়ে আছো পরম মমতা-ভালবাসায়
বলি রেখা, এসব হচ্ছে কি

আর কতদিন, চিন্তাগুলি তোমার কোলে ধরে রাখবে,
তোমার কি অবসর নেই,
কাঁদছো তুমি

যৌবনে কত স্বপ্ন দেখেছো, পুড়িয়েছো কত দুঃখ-ব্যথা
বহন করেছো সূখের আশায় মিথ্যে কত স্বপ্ন সাধ
তাহলে কেন ভেঙ্গে পড়েছো

ওঠো! দাঁড়িয়ে দেখো পুবাল হাওয়া
অনুভবে আনো চির শান্তি
মিলিয়ে যাও গভীর বিষাদে
অনেক দূরে পালিয়ে যাও
হয়তো তোমার আশা পূরণ হবে
বলি রেখা তুমি শান্ত হও

এই না হলো সাহস তোমার। কথা মানতে পারো তুমি
কেটে গেল অ...নে...ক দিন!

ওমা! লক্ষ্মী বলি রেখা, তুমি ফিরে এসেছো
সত্যি বন্ধু, তোমার ভীষন প্রয়োজন এই দুর্দিনে
বলি রেখা তোমার নিস্তার নেই।
থাকো আমার সাথে...!




২৭।০৮।০৪

বুধবার, ২৬ মার্চ, ২০১৪

পতাকা- রাশেদুজ্জামান রন।

সুনসান নিরবতা...!

একটা বিরান প্রান্তর...
মরচে পড়া আধো সোনালী রঙ
কিংবা স্যাঁতস্যেঁতে শ্যাওলা মাটিময়
অথবা পুড়ে যাওয়া ছাই রঙ্গা বুকের জমিন!

লাল রঙ বৃষ্টিতে ভাসিয়ে দু'কূল
পাজরের হাড় ক'খানা
ছিন্ন-বিছিন্ন শাড়ী
বেড়িয়ে আসা লজ্জায় নত করোটি!

বারুদের গন্ধে মাতম তোলে
হিংস্র হায়েনা
সঙ্গমে রত শুয়োরের দল
অবলীলায় ভুলে যায় মনুষ্যত্ব
ধম্মের বাণী পদতলে
নীতির বালাই নেই
ম্যাকিয়েভেলি ধন্যবাদ তোমায়!

মহা প্লাবন শুরু হয় জনন যন্ত্রে
উগড়ে দেয় রিক্ত হস্ত
ছোট্ট ডেভিড ছুটে চলে
গোলিয়াথের খোঁজে...!

মায়ের হাসি
বোনের টিকলি
বাবার চটি
দিদার চশমা
ফিরিয়ে দিতে চাই!

কাঁদতে থাকে শিশু তপ্ত চোখে
জলে জলে সিজিত প্রান্তর
সবুজে সবুজে গাঢ় সবুজ
ঢেলে দিলাম পাজরের লাল!

*মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়লে, মুক্তিযোদ্ধা ও পতাকা দেখলে, দেশের গান শুনলে বুকের ভিতর ক্যামন যেনো করে...! প্রবাসীদের নিশ্চয় আরো বেশি করে! আমার সেই সমস্ত ভাই ও বন্ধুদের তরে...
রাশেদুজ্জামান রন।

দোতলার ল্যন্ডিং মুখোমুখি ফ্ল্যাট। একজন সিঁড়িতে, একজন দরোজায় -আহসান হাবীব

: আপনারা যাচ্ছেন বুঝি?
: চ’লে যাচ্ছি, মালপত্র উঠে গেছে সব।
: বছর দু’য়েক হ’লো, তাই নয়?
: তারো বেশি। আপনার ডাকনাম শানু, ভালো নাম?
: শাহানা, আপনার?
: মাবু।
: জানি।
: মাহবুব হোসেন। আপনি খুব ভালো সেলাই জানেন।
: কে বলেছে। আপনার তো অনার্স ফাইনাল, তাই নয়?
: এবার ফাইনাল
: ফিজিক্স-এ অনার্স।
: কি আশ্চর্য। আপনি কেন ছাড়লেন হঠাৎ?
: মা চান না। মানে ছেলেদের সঙ্গে ব’সে…
: সে যাক গে, পা সেরেছে?
: কি ক’রে জানলেন?
: এই আর কি। সেরে গেছে?
: ও কিছু না, প্যাসেজটা পিছল ছিলো মানে…
: সত্যি নয়। উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে…
: ধ্যাৎ। খাবার টেবিলে রোজ মাকে অতো জ্বালানো কি ভালো?
: মা বলেছে?
: শুনতে পাই? বছর দুয়েক হ’লো, তাই নয়?
: তারো বেশি। আপনার টবের গাছে ফুল এসেছে?
: নেবেন? না থাক। রিকসা এলো, মা এলেন, যাই।
: যাই। আপনি সন্ধেবেলা ওভাবে পড়বেন না,
চোখ যাবে, যাই।
: হলুদ শার্টের মাঝখানে বোতাম নেই, লাগিয়ে নেবেন, যাই।
: যান, আপনার মা আসছেন। মা ডাকছেন, যাই।

সোমবার, ২৪ মার্চ, ২০১৪

ভারবাহী পশু- রাশেদুজ্জামান রন।

শৈশব-কৈশোর ছাড়িয়ে যৌবনের উত্তেজনায় মিশে থাকে
অনেক আশা
ভালবাসার ভাববাদী সংক্রমণে উড়ে আসে এক ঝাঁক স্বপ্ন,
আশা ও স্বপ্নের সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয় পাওয়া না পাওয়ার
খেরো খাতা
বংশ দন্ডের উচ্চ লম্ফে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ে অনাগত ভবিষ্যত
সন্তান! তুমিতো আমার দুঃখ মোচনের শোষক পেপার
শুষে নাও আমার যত দুখ...
সত্যি, পারো কি তাই
আজো হিসেব মেলেনি

সব বন্ধন ছিন্ন করে বৈষয়িক ভাবনায় গড়ে ওঠে একজন ভারবাহী পশু
উত্তেজিত প্রতিবাদ বা মিঁইয়ে পড়া মৌনতায় জমে ওঠে কানাকানি
অভিমানগুলো স্বার্থপরতার ঢঙ্গে আত্নপ্রকাশ করে আপন আলয়ে
প্রকাশ্যে ভালবাসা পূর্ণরুপে এলেও আড়ালেই তার কদর্য রুপ
এ যেনো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ!

বৈষয়িক লালসায় পশু হয় স্বার্থপর পাষাণ
সম্পদের লোভে বন্ধন হয়ে পড়ে কন্টকময়
অস্থি-চর্ম সার খোলসের ভিতরে ভারবাহী পশু,
বলে ওঠে, "আমাকে মুক্তি দাও!"

শুরু ও শেষের কান্নার মাঝে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাইনা
ভারবাহী পশু, কী হবে এসব দিয়ে?

*বৈরাগ্য ভাববেন না, উপলব্ধি ভাবুন!

বৃত্ত- রাশেদুজ্জামান রন।

জানালা গলে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে রুপালী চাঁদ
মৃদুমন্দ হাওয়ার সাথে জোট বেঁধেছে
নিরাবরণ দেহে আছড়ে পড়ে চুম দেয়
এলো চুলের নরম ছোঁয়া

আবেশ ছড়ানো স্পর্শে মাতাল প্রকৃতি
নোনা জল শুষে নেয় দুঃখগুলো
নৈঃশব্দের মাঝে খেলা করে ঝিঁঝিঁ পোকা...
জোনাক হারিয়েছে তাবৎ আলো
ধর্ষিত আজ চাঁদের কাছে
তবুও আনন্দিত, লাজ-শরমের বালাই নেই

একাকি নির্ঘুম
ভেবে চলেছি, "আমরাও তো তাই...!"
প্রকৃতির কাছে হেরে চলেছি প্রতিনিয়ত
তবু দর্প কমেনা একটুও

অহংবোধের দোরে দেয়াল তুলেছি
আমিত্বের ইট-বালুতে
খসে পড়া দেহ লুকোতে
খুঁজে নেই মিথ্যে ছল-ছুতো

শেষে খুঁজে ফিরি আমি কে, তুমি কে?

২৪।০৩।১৪

বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০১৪

একটি পতাকা পেলে – হেলাল হাফিজ।



কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে

আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা

কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে

ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস

ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন,–’পেয়েছি, পেয়েছি’।

কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে

পাতা কুড়োনির মেয়ে শীতের সকালে

ওম নেবে জাতীয় সংগীত শুনে পাতার মর্মরে।

কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে

ভূমিহীন মনুমিয়া গাইবে তৃপ্তির গান জ্যৈষ্ঠে-বোশেখে,

বাঁচবে যুদ্ধের শিশু সসন্মানে সাদা দুতে-ভাতে।

কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে

আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে,

সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ

সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।

কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প – রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ।

তাঁর চোখ বাঁধা হলো।
বুটের প্রথম লাথি রক্তাক্ত করলো তার মুখ।

থ্যাতলানো ঠোঁটজোড়া লালা-রক্তে একাকার হলো,
জিভ নাড়তেই দুটো ভাঙা দাঁত ঝরে পড়লো কংক্রিটে।
মা…..মাগো….. চেঁচিয়ে উঠলো সে।

পাঁচশো পঞ্চান্ন মার্কা আধ-খাওয়া একটা সিগারেট
প্রথমে স্পর্শ করলো তার বুক।
পোড়া মাংসের উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো ঘরের বাতাসে।
জ্বলন্ত সিগারেটের স্পর্শ
তার দেহে টসটসে আঙুরের মতো ফোস্কা তুলতে লাগলো।

দ্বিতীয় লাথিতে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে গেলো দেহ,
এবার সে চিৎকার করতে পারলো না।

তাকে চিৎ করা হলো।
পেটের ওপর উঠে এলো দু’জোড়া বুট, কালো ও কর্কশ।
কারণ সে তার পাকস্থলির কষ্টের কথা বলেছিলো,
বলেছিলো অনাহার ও ক্ষুধার কথা।

সে তার দেহের বস্ত্রহীনতার কথা বলেছিলো-
বুঝি সে-কারণে
ফর ফর করে টেনে ছিঁড়ে নেয়া হলো তার শার্ট।
প্যান্ট খোলা হলো। সে এখন বিবস্ত্র, বীভৎস।

তার দুটো হাত-
মুষ্টিবদ্ধ যে-হাত মিছিলে পতাকার মতো উড়েছে সক্রোধে,
যে-হাতে সে পোস্টার সেঁটেছে, বিলিয়েছে লিফলেট,
লোহার হাতুড়ি দিয়ে সেই হাত ভাঙা হলো।
সেই জীবন্ত হাত, জীবন্ত মানুষের হাত।

তার দশটি আঙুল-
যে-আঙুলে ছুঁয়েছে সে মার মুখ, ভায়ের শরীর,
প্রেয়সীর চিবুকের তিল।
যে-আঙুলে ছুঁয়েছে সে সাম্যমন্ত্রে দীক্ষিত সাথীর হাত,
স্বপ্নবান হাতিয়ার,
বাটখারা দিয়ে সে-আঙুল পেষা হলো।
সেই জীবন্ত আঙুল, মানুষের জীবন্ত উপমা।
লোহার সাঁড়াশি দিয়ে,
একটি একটি করে উপড়ে নেয়া হলো তার নির্দোষ নখগুলো।
কী চমৎকার লাল রক্তের রঙ।

সে এখন মৃত।
তার শরীর ঘিরে থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়ার মতো
ছড়িয়ে রয়েছে রক্ত, তাজা লাল রক্ত।

তার থ্যাতলানো একখানা হাত
পড়ে আছে এদেশের মানচিত্রের ওপর,
আর সে হাত থেকে ঝরে পড়ছে রক্তের দুর্বিনীত লাভা-

তোমার কথা ভেবে – রফিক আজাদ।

তোমার কথা ভেবে রক্তে ঢেউ ওঠে—
তোমাকে সর্বদা ভাবতে ভালো লাগে,
আমার পথজুড়ে তোমারই আনাগোনা—
তোমাকে মনে এলে রক্তে আজও ওঠে
তুমুল তোলপাড় হূদয়ে সর্বদা…
হলো না পাশাপাশি বিপুল পথ-হাঁটা,
এমন কথা ছিল চলব দুজনেই
জীবন-জোড়া পথ যে-পথ দিকহীন
মিশেছে সম্মুখে আলোর গহ্বরে…

কেউ কথা রাখেনি-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি
ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমী তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল
শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে
তারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো, কিন্তু সেই বোষ্টুমী
আর এলোনা
পঁচিশ বছর প্রতিক্ষায় আছি।

মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর
তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো
সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর
খেলা করে!
নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো? আমার মাথা এ ঘরের ছাদ
ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায়
তিন প্রহরের বিল দেখাবে?

একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনো
লাঠি-লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্করবাড়ির ছেলেরা
ভিখারীর মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি
ভিতরে রাস-উৎসব
অবিরল রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফর্সা রমণীরা
কত রকম আমোদে হেসেছে
আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি!
বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস, একদিন, আমরাও…
বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুই
সেই রয়্যাল গুলি, সেই লাঠি-লজেন্স, সেই রাস-উৎসব
আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবেনা!

বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল,
যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবে
সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!
ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠেয়ে প্রাণ নিয়েছি
দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়
বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীল পদ্ম
তবু কথা রাখেনি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ
এখনো সে যে-কোনো নারী।
কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখে না!

ব্যাধিকে রূপান্তরিত করছি মুক্তোয় – হুমায়ুন আজাদ

একপাশে শূন্যতার খোলা, অন্যপাশে মৃত্যুর ঢাকনা,
প’ড়ে আছে কালো জলে নিরর্থক ঝিনুক।
অন্ধ ঝিনুকের মধ্যে অনিচ্ছায় ঢুকে গেছি রক্তমাংসময়
আপাদমস্তক বন্দী ব্যাধিবীজ। তাৎপর্য নেই কোন দিকে-
না জলে না দেয়ালে-তাৎপর্যহীন অভ্যন্তরে ক্রমশ উঠছি বেড়ে
শোণিতপ্লাবিত ব্যাধি। কখনো হল্লা ক’রে হাঙ্গরকুমীরসহ
ঠেলে আসে হলদে পুঁজ, ছুটে আসে মরা রক্তের তুফান।
আকষ্মিক অগ্নি ঢেলে ধেয়ে আসে কালো বজ্রপাত।
যেহেতু কিছুই নেই করণীয় ব্যাধিরূপে বেড়ে ওঠা ছাড়া,
নিজেকে-ব্যাধিকে-যাদুরসায়নে রূপান্তরিত করছি শিল্পে-
একরত্তি নিটোল মুক্তোয়!

বুধবার, ১৯ মার্চ, ২০১৪

মানবানল- হেলাল হাফিজ।


আগুন আর কতটুকু পোড়ে? 
সীমাবদ্ধ তার ক্ষয় সীমিত বিনাশ,
মানুষের মতো আর অতো নয় আগুনের সোনালি সন্ত্রাস।

আগুন পোড়ালে তবু কিছু রাখে
কিছু থাকে,
হোক না তা ধূসর শ্যামল রঙ ছাই,
মানুষ পোড়ালে আর কিছুই রাখে না
কিচ্ছু থাকে না,
খাঁ খাঁ বিরান, আমার কিছু নাই। 

০৭.০২.১৯৮১ 
কাব্যগ্রন্থঃ যে জলে আগুন জ্বলে।  

অহংকার- হেলাল হাফিজ।

বুকের সীমান্ত তুমিই বন্ধ করেছো
খুলে রেখেছিলাম অর্গল,
আমার যুগল চোখে ছিলো মানবিক খেলা
তুমি শুধু দেখেছো অনল।

তুমি এসেছিলে কাছে, দুরেও গিয়েছো যেচে
ফ্রিজ শটে স্থির হয়ে আছি,
তুমি দিয়েছিলে কথা, অপারগতার ব্যাথা
সব কিছু বুকে নিয়ে বাঁচি।

উথাল পাথাল করে সব কিছু ছুয়ে যাই
কোনো কিছু ছোয় না আমাকে,
তোলপাড় নিজে তুলে নিদারুন খেলাচ্ছলে
দিয়ে যাই বিজয় তোমাকে।

১৩.১০.১৯৮০
কাব্যগ্রন্থঃ যে জলে আগুন জ্বলে। 

শনিবার, ১৫ মার্চ, ২০১৪

পাগলা হাওয়া- রাশেদুজ্জামান রন।

উনপাজুরে মনে লেগেছে ঊনপঞ্চাশের বায়ু
তরু-অরণ্যে নতুনের আহ্ববান
পাখ-পাখালীর ডাকাডাকি, ভেঙ্গে ফেলে সব অর্গল।
সঙ্গম কাল কি আসন্ন?

শিরায় শিরায় কামের আগুন
প্রেয়সীর ঠোঁটে কোমল চুম্বন
নত আজ কামাতুর দৃষ্টি...
বিরহী কোকিলের গান থেমে যায়

হাওয়ার বেগে নাচতে থাকে হাওয়ার গাড়ি
চোখে ভাসে রঙ্গিন স্বপ্ন সারি সারি
সেই সাদা-কালো স্বপ্ন হলো আজ সত্য
আহা! ইহাই কি বসন্ত?

*আমিও ভাবছি...এটাই কি বসন্ত!


১৬।০৩।২০১৪

শুক্রবার, ১৪ মার্চ, ২০১৪

অদৃশ্য ছাঁয়া- রাশেদুজ্জামান রন।

আমি ভালবেসেছি তোমাকে, অনেক বছর আগে
ভালবাসা পেয়ে অমানুষ, তাই উঠেছে জেগে
শাসনের সুরে বারণ করেছো, কখনো উঠেছো রেগে!


আমি ভালবেসেছি তোমাকে, প্রতিশোধ-অপমানে
স্পর্শহীন রাত্রি কাটে, শুধু গান আর গানে
প্রত্যাশার চাপ দায়িত্ব বাড়ায়, বিভেদের রেখা টানে!


আমি ভালবেসেছি তোমাকে, উচ্চ করি শির
অথই সাগর, হারিয়ে ফেলেছো তোমার তূণের তীর
প্রত্যাশিত সাফল্যে তাই নাবিকেরা করে ভীড়!

আমি ভালবেসেছি তোমাকে, প্রথম ব্যর্থ হয়ে
হলোনা সুযোগ, পেলেনা তুমি, আনন্দটা ক্ষয়ে
অতীত গ্লানি, ভাসছে ছবি, তোমার পরাজয়ে!

আমি ভালবেসেছি তোমাকে, তাই ভয় করবো কেন
সাহসের সাথে সঙ্গ দিয়েছি, স্বার্থ ছিলনা জেনো
সাফল্যের আলোক ছটায়, হারালাম আমি মানো?

তবুও আমি তোমাকে ভালবেসেছি, বোঁকার স্বর্গে থেকে
ভালবাসা পেয়ে উন্মাদ তাই উঠবেনা আর জেগে
ভালবাসাহীন নির্মমতায় উঠেছো কখনোও রেগে!


** সুন্দরের উপাসনা সবাই করে ভক্তি ভরে,
তবুও কেন পূজারীদের ভুল রয়েই যায়?


০৯।০৮।০৪

বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ, ২০১৪

টুকরো সংজ্ঞা- রাশেদুজ্জামান রন।

বসন্ত। পলাশ ফুলের মাতামাতি,
বন্ধুদের কোলাহল!
নতুনের সাথে পরিচয়, সব ভাললাগে,
এর মাঝেও চোরাটান। বিষাদ, না উচ্ছলতা?
কার কাছে এ প্রশ্ন, জানিনা।


ভবঘুরে। বস্তিতে তোর জায়গা নাই।
ধিক্কারের শোরগোল!
স্ব-জাতির সাথে কোন্দল। সব কিছু ফাঁকা লাগে,
এর মাঝেও গায় গান। হাসি, না উপহাস?
কে জানে এর উত্তর, আমি জানিনা।


বন্ধু। কৃত্রিমতার চরম প্রকাশ,
আবেগের বেদম ছড়াছড়ি!
অভিনয়ের পাঠ শেখা, সব কৌশল ছেলেখেলা,
তবুও সেই অমোঘ ভাষণ, "তোমায় খুব ভালবাসি।"
ন্যাড়া পাগল! বেলতলায় ক'বার যাবি?


শত্রু। সেওতো ভাল,
হলে সত্যের মহান বিজয়!
স্বকীয় শক্তির ভাষা, দারুণ ভাবে জানান দেয়,
তার ছাঁয়া মাড়িয়ে যাবো, ভয় পাই নিজেকে।
ভেবে তুই, বল দেখি, আমি কে?


২৭।০২।২০০৭

বুধবার, ১২ মার্চ, ২০১৪

দুঃসময়ে আমার যৌবন- হেলাল হাফিজ।

মানব জন্মের নাম হবে কলঙ্ক হবে
এরকম দুঃসময়ে আমি যদি মিছিলে না যাই,
উত্তর পুরুষে ভীরু কাপুরুষের উপমা হবো
আমার যৌবন দিয়ে এমন দুর্দিনে আজ
শুধু যদি নারীকে সাজাই।

----------------
হেলাল হাফিজ।
১৪।০২।১৯৭১
কাব্যগ্রন্থঃ যে জলে আগুন জ্বলে। 

নিরাস্রয় পাঁচটি আঙুল- হেলাল হাফিজ।

নিরাস্রয় পাঁচটি আঙুল তুমি নির্দ্বিধায়
অলংকার করে নাও, এ আঙুল ছলনা জানে না।
একবার তোমার নোলক, দুল, হাতে চুড়ি
কটিদেশে বিছা করে অলংকৃত হতে দিলে
বুঝবে হেলেন, এ আঙুল সহজে বাজে না।

একদিন একটি বেহালা নিজেকে বাজাবে বলে
আমার আঙুলে এসে দেখেছিল
তার বিষাদের চেয়ে বিশাল বিস্তৃতি,
আমি তাকে চলে যেতে বলিনি তবুও
ফিরে গিয়েছিল সেই বেহালা সলাজে।

অসহায় একটি অঙ্গুরি
কনিষ্ঠা আঙুলে এসেই বলেছিল ঘর,
অবশেষে সেও গেছে সভয়ে সলাজে।

ওরা যাক, ওরা তো যাবেই
ওদের আর দুঃখ কতটুকু? ওরা কি মানুষ?

হেলাল হাফিজ
০২।০৪।১৯৭০
কাব্যগ্রন্থঃ যে জলে আগুন জ্বলে। 

জড় পথিক- রাশেদুজ্জামান রন।

উচ্ছন্নে যাওয়া স্বপ্নগুলো
ডানা মেলেছে,
অন্ধকারে পথ হাঁতড়ে বেড়ায় পথের আলো যুগো্‌ল,
তাই পথেই দাঁড়াই।
আগলে দাঁড়ানো পথ ছিল সংকীর্ণ,
পরের চর্চায় পরনিন্দা হয় হতভম্ব,
মানুষের ধ্বজা ধরে উড়িয়েছি আশার ছাই।


বেড়ালের জ্বলজ্বলে চোখ খোঁজে বাসাহার,
হিংস্রতা নয় ক্ষুরধার প্রয়োজনীয়তা শেখায় দক্ষতা,
মায়ার বাঁধনে বলে ওঠে মিঁউ মিঁউ,
তপ্ত নিঃশ্বাসে ভারি হয়ে ওঠে ভালবাসা,
ওম ছড়িয়ে যায়!

আজ শুধু উষ্ণতার যুদ্ধ, বাজবে রণদামামা,
কূটচালে ঘায়েল শত্রুপক্ষ,
নিজের অজান্তেই হয়তো, পরাজয়ের ছোঁয়ায় আক্রান্ত,
বুঝতে পারছিনা!
যুক্ত হবেনা ছেঁড়া পাল,
তড়তড়িয়ে যাওয়া হয়নি কোনোদিন,
তাই স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেই হাঁটতে থাকো...!


২৪।০৮।০৮

স্বাধীনতা তুমি- রাশেদুজ্জামান রন

স্বাধীনতা তুমি, স্ব-অধীনতার আবরণে জড়িয়ে থাকা শ্বেতপত্র
স্বাধীনতা তুমি, নাম না জানা দুঃখী মানুষের রক্তে লেখা মানচিত্র
স্বাধীনতা তুমি, কঠোর শ্রমে সৃষ্টি হওয়া আবীর ছড়ানো মাঠ
স্বাধীনতা তুমি, তরুণ তুর্কী, বীর আসাদের রক্তে ভেজা শার্ট

পশ্চিমাদের নিপুণ থাবায় দ্বি-চক্রের সংঘাত
শোষকের রুপে দুই বেহায়ার মিলিত বাদ-বিবাদ
স্বাধীনতা তুমি, উত্তাল গতিতে সৃষ্টি করেছো, সাত মার্চের ভাষণ
স্বাধীনতা তুমি, মীরজাফর ও রাজাকারদের মিথ্যা আস্ফালন

গোপনে পালানো, ছোটাছুটি আর হৃদয়ের আহাজারী
মা ছাড়ে শিশু, মাতৃভূমি আর মানুষ শত সারি
ন'মাসে শেষ প্রসব বেদনা, বাঙ্গালীর হুংকারে
পরাজিত হয়ে হায়েনা শাবক, সোনার বাংলা ছাড়ে

স্বাধীনতা তুমি, এলে বীরবেশে রক্ত দেবার পর
দেখেছে বিশ্ব; অবাক নেত্রে, নরপশুদের ঝড়
স্বাধীনতা তুমি, ধ্বংস বিপুল সীমাহীন শুন্যতা
ছিন্ন আত্নায় মিলেছে তবুও মুক্তির বারতা

স্বাধীনতা তুমি, পরাধীনতার 'নামবাচক' শৃংখল
স্বাধীনতা তুমি, খুলে দাও সব সম্ভাবনার অর্গল
স্বাধীনতা তুমি, পতাকা জড়ানো হৃদয়ের সততা
স্বাধীনতা তুমি, মনের শক্তি, তুমি-ই স্বাধীনতা।


রাশেদুজ্জামান রন

২০০৭


*** কবি রাশেদুজ্জামান রন এই কবিতাটি লিখেছিলেন ২০০৭ সালে। ২০০৭ সালের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে টেলিটক "স্বাধীনতা তুমি" শিরোনামে কবিতা আহ্বান করে। সেই ফরমায়েশ পূরণ করতে কবিতাটি লেখেন কবি রাশেদুজ্জামান রন।

শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

জর্নালঃ স্মৃতিচিত্র -- দাউদ হায়দার

কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছিল

মেঘের প্রবল খেলার ভঙ্গিতে আমি একা নিবিড় শুয়েছিলাম
                                                            কোমল শয্যার শরীরে  
আমার চারিদিকে বৃষ্টির নিপুন করতালি 
                                                       ডাকছিল আমাকে।
"আয় আয় ভিজে উঠি গুরুজনের দারুন চোখ ফাকি দিয়ে"--
যেন পেয়ে গেছে বালকবেলার সাথী!

কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছিল 
                                    টিনের ছাদে খেলছিল তুমুল 

যৌবনের ব্যাস্ত প্রেমিকের মতো ছুটেছিল পার্কে বাগানে--
নদী কি এখনো বসে আছে ভীষণ উৎকণ্ঠায়?
আমি তো মেঘের অনুচর            বিষে নীল গোলাপ
শহরময় হেঁটে গেলে ঘেমে যায় ক্ষয়িত পাথর 
আমি তো জ্যোৎস্নার শত্রু ঘন কুয়াশা বৃক্ষের বন্ধু!

আমার খেলার ভঙ্গিতে বর্ষাতি চাপিয়ে গায় হেঁটে যায় মহাজন
                                                                             রাজাধিরাজ
ব্যাকুল চেয়ে থাকে সম্রাজ্ঞীর করুন হৃদয়             কিশোরীর বুক
আমি তো খেলছি এই মধ্যরাতে; টিনের ছাদে খেলছি একা একা 
                                                                                                সখী নেই 
আমি তো এক্ষুনি চলে যাবো বিষণ্ণ মেঘের ইশারায় 
                                                                           হয়তো বা
সেই মেঘ ভেবেছিল বহুবার? 

আমি একা শুয়ে আছি; নিবির শুয়ে আছি  
                                                         কোমল শয্যার শরীরে 
সেই বৃষ্টি এখনো কি সখী বিনা ঘুরে বেড়ায় আকাশের একলা পথে 
আমি যেমন শুয়ে আছি এই বিজন ঘরে?

১২।০৭।১৯৭২ 
গ্রন্থঃ জন্মই আমার আজন্ম পাপ। 

মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

জন্মই আমার আজন্ম পাপ- দাউদ হায়দার।

জন্মই আমার আজন্ম পাপ, মাতৃজরায়ু থেকে নেমেই জেনেছি আমি
সন্ত্রাসের ঝাঁঝালো দিনে বিবর্ণ পত্রের মত হঠাৎ ফুৎকারে উড়ে যাই
                                                              পালাই পালাই সুদূরে
চৌদিকে রৌদ্রের ঝলক
বাসের দোতলায় ফুটপাতে রুটির দোকানে দ্রুতগামী নতুন মডেলের
চকচকে বনেটে রাত্রির জমকালো আলো ভাংগাচোরা চেহারার হদিস


ক্লান্ত নিঃশব্দে আমি হেঁটে যাই
পিছনে ঝাঁকড়া চুলওয়ালা যুবক। অষ্টাদশ বর্ষীয়ার নিপুণ ভঙ্গী
দম্পতির অলৌকিক হাসি প্রগাঢ় চুম্বন
কাথায় জরানো শিশুর অসতর্ক চিৎকার
এবং
আমি দেখে যাই, হেঁটে যাই, কোথাও সামান্য বাতাসে উড়ে যাওয়া চাল-
                                                               অর্থাৎ আমার নিবাস।

ঘরের স্যাঁতসেতে মেঝেয় চাঁদের আলো এসে খেলা করে
আমি তখন সঙ্গমে ব্যর্থ, স্ত্রীর দুঃখ অভিমান কান্না
                                            সন্তান সন্তুতি পঙ্গু
পেটে জ্বালা, পাজরায় তেল মালিশের বাসন উধাও-

আমি কোথা যাই? পান্তায় নুনের অভাব।

নিঃসংগতাও দেখেছি আমি, উৎকন্ঠার দিনমান জ্বলজ্বলে বাল্বের মতোন
আমার চোখের মতো স্বজনের চোখ-

যেন আমুন্ড গ্রাস করবে এই আমাকেই
আমিই সমস্ত আহার নষ্ট করেছি নিমেষে।

শত্রুর দেখা নেই, অথচ আমারি শত্রু আমি-
জ্বলন্ত যৌবনে ছুটি ফ্যামিলি প্ল্যানিং কোথায়
                   কোথায় ডাক্তার কম্পাউন্ডার
               যারা আমাকে অপারেশন করবে?
পুরুষত্ব বিলিয়ে ভাবি, কুড়ি টাকায় একসের চাল ও অন্যান্য
                                        সামান্য দ্রব্যাদী মিলবে তো?

আমার চৌদিকে উৎসুক নয়ন আহ্লাদী হাসি ঘৃণা আমি পাপী

এরা কেন জন্ম নেয়? এরাই তো আমাদের সুখের বাধা অভিশাপ।
মরণ এসে নিয়ে যাক, নিয়ে যাক
                               লোকালয়ের কিসের ঠাঁই এই শত্রুর? -বলে
                               প্রাসাদ প্রেমিকেরা

আমিও ভাবি তাই, ভাবি নতুন মডেলের চাকায় পিষ্ট হবো
আমার জন্যই তোমাদের এত দুঃখ
       আহা দুঃখ
       দুঃখরে!

আমিই পাপী, বুঝি তাই এ জন্মই আমার আজন্ম পাপ।

০২।০২।১৯৭২

বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

রূপম-সুবোধ সরকার

রূপমকে একটা চাকরি দিন—এম. এ পাস, বাবা নেই
আছে প্রেমিকা সে আর দু’-এক মাস দেখবে, তারপর
নদীর এপার থেকে নদীর ওপারে গিয়ে বলবে, রূপম
আজ চলি
তোমাকে মনে থাকবে চিরদিন
রূপমকে একটা চাকরি দিন, যে কোন কাজ
পিওনের কাজ হলেও চলবে |
তমালবাবু ফোন তুললেন, ফোনের অন্য প্রান্তে
যারা কথা বলেন
তাদের যেহেতু দেখা যায় না, সুতরাং তারা দুর্জ্ঞেয় |
তমালবাবু মামাকে বললেন কূপমের একটা চাকরি দরকার
মামা বললেন কাকাকে, কাকা বললেন জ্যাঠাকে,
জ্যাঠা বললেন
বাতাসকে |
মানুষ জানলে একরকম, কিন্তু বাতাস জানলে
প্রথমেই ছুটে যাবে দক্ষিণে, সে বলবে দক্ষিণের অরণ্যকে
অরণ্য বলবে আগুনকে, আগুন গেল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে
আলিমুদ্দিন ছুটল নদীকে বলার জন্য
নদী এসে আছড়ে পড়ল
উপকূলে, আসমুদ্র হিমাচল বলে উঠল
রূপমকে একটা চাকরি দাও, এম. এ. পাশ করে বসে আছে ছেলেটা |
কয়েক মাস বাদের ঘটনা, আমি বাড়িফিরছিলাম সন্ধেবেলায়
গলির মোড়ে সাত-আটজনের জটলা দেখে থমকে দাঁড়ালাম
জল থেকে সদ্য তুলে আনা রূপমের ডেডবডি
সারা গায়ে ঘাস, খরকুটো, হাতের মুঠোয়
ধরে থাকা একটা এক টাকার কয়েন |
পাবলিক বুথ থেকে কাউকে ফোন করতে চেয়েছিল, রূপম?
ভারত সরকারের এক টাকা কয়েনের দিকে আমার চোখ |
সারা গায়ে সবুজ ঘাস, ঘাস নয়, অক্ষর
এম. এ. পাস করতে একটা ছেলেকে যত অক্ষর পড়তে হয়
সেই সমস্ত ব্যর্থ অক্ষর ওর গায়ে লেগে আছে |
একটা ছেলেকে কেন আপনারা এম. এ. পড়ান, কোন আহ্লাদে আটখানা
বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়েছেন? তুলে দিন
এই কথাগুলো বলব বলে ফোন তুললাম পবিত্র সরকারের
ফোন বেজে উঠল, ফোন বেজে চলল, ফোন বেজেই চলল
২০ বছর ধরে ওই ফোন বেজে চলেছে, আরো কুড়ি বছর বাজবে |
বাতাস বলছে অরণ্যকে, অরণ্য চলেছে নদীর দিকে
নদী উপকূল থেকে আছড়ে পড়ে বলল :
রূপমকে একটা চাকরি দিন |
কে রূপম?
রূপম আচার্য, বয়স ২৬, এম. এ. পাস
বাঁ দিকের গালে একটা কাটা দাগ আছে |

শিয়রে বাংলাদেশ- নির্মলেন্দু গুন।

আমার যখন পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়েছিলো,
তুই তখনও ছিলি আমার স্বপনে।
আমি পাঁজর খুলে বলেছিলাম তোকে,
আমার বুকে যা আছে তুই সব নে ॥
আমার যখন পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়েছিলো,
তুই তখনও ছিলি মায়ের ভ্রণে।
আমি অস্ত্রজ্ঞানে আড়াল করে তোকে
তীর বানিয়ে রেখেছিলাম তূণে ॥
আমার যখন পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়েছিলো,
তুই তখনও ছিলি জন্ম-আশায়।
তোকেই তখন বড় করে দেখেছিলাম বলে
সঁপিনি মন নারীর ভালোবাসায় ॥
আমার যখন পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়েছিলো,
অস্ত্র তুলে নিয়েছিলাম হাতে।
যুদ্ধ করতে গিয়েছিলাম দূরপাহাড়ী বনে
যদিও সায় ছিলো না হত্যাতে ॥
আমার যখন পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়েছিলো,
টগবগে লাল রক্ত ছিলো বক্ষে।
তখন তোকে নরক থেকে মুক্ত করা ছাড়া
আর কী শ্রেয় ছিলো আমার পক্ষে ?
আমার যখন পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়েছিলো,
বিজয়-গর্ব ছিলো না তোর স্বরে।
আমি তোকে বিজয় দিয়ে বিজয়বতী করে
দিয়েছিলাম ষোলোই ডিসেম্বরে ॥
এখন যখন পঁচিশ বছর পূর্ণ হলো তোর,
আমি তখন তোকে রেখে পঞ্চাশে দেই দৌড়।
রজতে নয়, সুবর্ণতে এ-দৌড় হবে শেষ,
তখনও তুই থাকবি আমার শিয়রে বাংলাদেশ।

আহা আজি এ বসন্তে-রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর।

আহা আজি এ বসন্তে
এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে
এত পাখি গায় আহা আজি এ বসন্তে।।
সখির হৃদয় কুসুম কোমল
আর অনাদরে আজি ঝড়ে যায়
কেন কাছে আস, কেন মিছে হাসো
কাছে যে আসে তো, সে তো আসিতে না চায়।।
সুখে আছে যারা সুখে থাক তারা
সুখের বসন্ত সুখে হোক সারা
দুঃখিনী নারীর নয়নেরও নীড়
সুখি জনে যেন দেখিতে না পায়
তারা দেখেও দেখে না তারা বুঝেও বোঝেনা
তারা ফিরেও না চায়।।

ফুল ফুটুক না ফুটুক- সুভাষ মুখোপাধ্যায়।

ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।

শান-বাধানো ফুটপাথে
পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাটখোট্টা গাছ
কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে
হাসছে।

ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।

আলোর চোখে কালো ঠুলি পড়িয়ে
তারপর খুলে-
মৃত্যুর কোলে মানুষকে শুইয়ে দিয়ে
তারপর তুলে-
যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে
যেন না ফেরে।

গায়ে হলুদ দেওয়া বিকেলে
একটা দুটো পয়সা পেলে
যে হরবোলা ছেলেটা
কোকিল ডাকতে ডাকতে যেত
- তাকে ডেকে নিয়ে গেছে দিনগুলো।

লাল কালিতে ছাপা হলদে চিঠির মতো
আকাশটাকে মাথায় নিয়ে
এ- গলির এক কালোকুচ্ছিত আইবুড়ো মেয়ে
রেলিঙে বুক চেপে ধরে
এইসব সাত পাঁচ ভাবছিল।

ঠিক সেই সময়
চোখের মাথা খেয়ে গায়ে উড়ে এসে বসলো
আ মরন! পোড়ামুখ লক্ষ্মীছাড়া প্রজাপতি!

তারপর দড়াম করে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ।
অন্ধকারে মুখ চাপা দিয়ে
দড়ি পাকানো সেই গাছ
তখন ও হাসছে। 

মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

প্যারিস রোড- সাইদ জামান

দেখেছো চাঁদ কিভাবে হাসছে ঐ গগনশিরিশের ফাকে উঁকি মেরে
দেখো কেমন বৃষ্টির মতো ঝড়ে পড়ছে জ্যোৎস্নার আলো
এই সোডিয়াম বাতি গুলো যদি নেভানো যেত
তোমাকে প্যারিস রোডের আসল সৌন্দর্য দেখাতে পারতাম
জানো আমার কেন যেন মনে হয়
আমি সহস্র বছর ধরে হেটে চলেছি এই পথ ধরে
দুচোখ ভড়ে দেখেছি শুধু দেখেছি
ওহো তোমাকে তো শিশিরসিক্ত ভোরের প্যারিস রোড দেখানো হয়নি
একদিন খুব ভোরে তোমাকে নিয়ে আসবো
একদম কিচির মিচির ভোঁরে
আর হ্যাঁ পড়ন্ত বিকেলের প্যারিস রোড ও কিন্তু দেখাবো তোমায়
দেখবে কেমন হলদেটে হয়ে ওঠে আশপাশ
তবে যদি ঝুম বৃষ্টিতে প্যারিস রোডে না হেটে থাকো
তবে আজীবন আমার চোখে হতভাগী হয়েই থাকবে।।

শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

তোমাকে ছাড়াও কবিতা -সাইদ জামান

তোমাকে ছাড়াও তো আমি বেচে আছি
দিব্যি শুয়ে বসে দিনতো কেটে যাচ্ছে
শুধু মাঝে মাঝে কাছের জিনিস ও কেমন ঝাপসা হয়ে ওঠে।।

তোমার পাশে না থেকেও তো আমি বেচে আছি
দিব্যি বসে জ্যোৎস্না দেখি
শুধু মাঝে মাঝে বুকের কাছে কে যেন খামচে ধরে।।

তোমাকে হারিয়েও তো আমি বেচে আছি
দিব্যি ঘাসফুল দেখে খুশি হয়ে উঠি...
শুধু মাঝে মাঝে কেমন চারপাশটা ফাঁকা হয়ে যায়।।

তোমার হাত ধরে না থেকেও তো আমি বেচে আছি
দিব্যি শরতের মেঘ জড়িয়ে ভাসতে ইচ্ছে করে
শুধু মাঝে মাঝে নিজেকে সুতো ছেড়া ঘুড়ির মতো মনে হয়।।

সোমবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৪

আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি – নির্মলেন্দু গুণ

আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি 
– নির্মলেন্দু গুণ

সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ
গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

শহিদ মিনার থেকে খসে-পড়া একটি রক্তাক্ত ইট গতকাল আমাকে বলেছে,
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
সমবেত সকলের মতো আমিও পলাশ ফুল খুব ভালোবাসি, ‘সমকাল’
পার হয়ে যেতে সদ্যফোটা একটি পলাশ গতকাল কানে কানে
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

শাহবাগ এ্যভিন্যুর ঘূর্ণায়িত জলের ঝরনাটি আর্তস্বরে আমাকে বলেছে,
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

সমবেত সকলের মতো আমারো স্বপ্নের প্রতি পক্ষপাত আছে,
ভালোবাসা আছে_ শেষ রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন গতকাল
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

এই বসন্তের বটমূলে সমবেত ব্যথিত মানুষগুলো সাক্ষী থাকুক,
না-ফোটা কৃষ্ণচূড়ার শুষ্কভগ্ন অপ্রস্তুত প্রাণের ঐ গোপন মঞ্জরীগুলো কান পেতে শুনুক,
আসন্ন সন্ধ্যার এই কালো কোকিলটি জেনে যাক_
আমার পায়ের তলায় পুণ্য মাটি ছুঁয়ে
আমি আজ সেই গোলাপের কথা রাখলাম, আজ সেই পলাশের কথা
রাখলাম, আজ সেই স্বপ্নের কথা রাখলাম।

আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি,
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।

সোমবার, ২০ জানুয়ারী, ২০১৪

ইচ্ছের অতৃপ্তি- সাইদ জামান।

ইচ্ছে করে শীতের সকালে
শিশির সিক্ত সবুজ ঘাস মাড়িয়ে
শিউলি ফুল কুড়োতে।।
ইচ্ছে করে সাগরের নোনা জলে
আলতো করে পা ভিজিয়ে
সূর্যাস্ত দেখতে।।
ইচ্ছে করে পাহাড় চুড়ায় দাঁড়িয়ে
দু হাত ছড়িয়ে সাধ মিটিয়ে
চোখ ভরে নীল আকাশ দেখতে।।

ইচ্ছের ডানা মেলা গ্যাস বেলুন
আবহমান বহমান
আঁকাবাঁকা রেলপথে
অতৃপ্তির সমান্তরাল পথচলা।।

বহমানতা-- সাইদ জামান।

ভালোবাসার পদদলিত আর্তনাদ

কষ্টের সরল আহ্বান

শকুনের লোভাতুর চোখ

দাঁড় কাকের ভয়াবহ বিষণ্ণতা


অতঃপর .....

আরেকটি নতুন সূর্যোদয়।

মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৪

ভালোবাসি ভালোবাসি—সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

"ভালোবাসি ভালোবাসি"
                —সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

ধরো যুদ্ধের দামামা বাজছে ঘরে ঘরে,
প্রচন্ড যুদ্ধে তুমি ও অংশীদার,
শত্রু বাহিনী ঘিরে ফেলেছে ঘর
এমন সময়
পাশে বসে পাগলিনী আমি তোমায়
জিজ্ঞেস করলাম—
ভালোবাস?
ক্রুদ্ধ স্বরে তুমি কি বলবে- যাও?
নাকি চিন্তিত আমায় আশ্বাস দেবে
বলবে
ভালোবাসি, ভালোবাসি.......

ধরো কোথাও যাচ্ছ তুমি
দেরি হয়ে যাচ্ছে, বেরুতে যাবে
বাধা দিয়ে বললাম ভালোবাস?
কটাক্ষ করবে?
নাকি সুটকেস ফেলে চুলে হাত
বুলাতে বুলাতে বলবে
ভালোবাসি, ভালোবাসি......

ধরো প্রচন্ড ঝড়
উড়ে গেছে ঘরবাড়ি, আশ্রয় নেই
বিধাতার দান এই পৃথিবীতে বাস
করছি দুজনে,চিন্তিত তুমি
এমন সময় তোমার বুকে মাথা রেখে যদি বলি ভালোবাস?
তুমি কি সরিয়ে দেবে?
নাকি মাথায় হাত রেখে বলবে
ভালোবাসি, ভালোবাসি......

ধরো সব ছেড়ে চলে গেছ কত দূরে
আড়াই হাত মাটির নিচে শুয়ে আছ
হতভম্ব আমি যদি চিতকার করে বলি- ভালোবাস?
চুপ করে থাকবে?
নাকি সেখান থেকেই আমাকে বলবে
ভালোবাসি, ভালোবাসি.....

যেখানে যাও,যেভাবেই থাকো,না থাকলে ও
দূর থেকে ধ্বনি তুলো
ভালোবাসি,ভালোবাসি,ভালোবাসি.....
দূর থেকে শুনব তোমার কন্ঠস্বর
বুঝবো
তুমি আছো, তুমি আছো;
ভালোবাসি, ভালোবাসি.......

শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী, ২০১৪

বাতাসে লাশের গন্ধ – রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

বাতাসে লাশের গন্ধ 
                  – রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই
আজো আমি মাটিতে মৃত্যূর নগ্ননৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে…
এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দু:স্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময় ?
বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে
মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।
এই রক্তমাখা মটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো।
জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আধাঁর,
আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।
এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আরষ্ট কুমারী জননী,
স্বাধীনতা – একি হবে নষ্ট জন্ম ?
একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল ?

জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন।
বাতাশে লাশের গন্ধ
নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দুলে মাংসের তুফান।
মাটিতে রক্তের দাগ -
চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়
এ চোখে ঘুম আসেনা। সারারাত আমার ঘুম আসেনা-
তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকার,
নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ
মুন্ডহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বিভৎস্য শরীর
ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে। আমি ঘুমুতে পারিনা, আমি
ঘুমুতে পারিনা…
রক্তের কাফনে মোড়া – কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে
সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা।
স্বাধীনতা, সে আমার – স্বজন, হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন -
স্বাধীনতা – আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।
ধর্ষিতা বোনের শাড়ী ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।

মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারী, ২০১৪

শাড়ি-সুবোধ সরকার

শাড়ি

   -সুবোধ সরকার


বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে আরো ছটা
এতো শাড়ি একসঙ্গে সে জীবনে দেখেনি।

আলমারির প্রথম থাকে সে রাখলো সব নীল শাড়িদের
হালকা নীল একটা কে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই আমার আকাশ
দ্বিতীয় থাকে রাখল সব গোলাপীদের
একটা গোলাপীকে জড়িয়ে সে বলল, ‘ তোর নাম অভিমান’
তৃতীয় থাকে তিনটি ময়ূর, যেন তিন দিক থেকে ছুটে আসা সুখ
তেজপাতা রং যে শাড়িটার, তার নাম দিল বিষাদ ।
সারা বছর সে শুধু শাড়ি উপহার পেল
এত শাড়ি সে কি করে এক জীবনে পড়বে ?

কিন্তু বছর যেতে না যেতেই ঘটে গেল সেই ঘটনাটা
সন্ধের মুখে মেয়েটি বেরিয়েছিল স্বামীর সঙ্গে, চাইনিজ খেতে ।
কাপড়ে মুখ বাঁধা তিনটি ছেলে এসে দাঁড়ালো
স্বামীর তলপেটে ঢুকে গেল বারো ইঞ্চি
ওপর থেকে নীচে। নীচে নেমে ডান দিকে ।
যাকে বলে এল ।
পড়ে রইলো খাবার, চিলি ফিস থেকে তখনও ধোঁয়া উড়ছে ।
-এর নাম রাজনীতি, -বলেছিল পাড়ার লোকেরা ।

বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে আরো ছটা
একদিন দুপুরে শাশুড়ি ঘুমিয়ে, সমস্ত শাড়ি বের করে
ছতলার বারান্দা থেকে উড়িয়ে দিল নীচের পৃথিবীতে ।
শাশুড়ি পড়িয়ে দিয়েছেন তাকে সাদা থান
উনিশ বছরের একটা মেয়ে সে একা ।

কিন্তু সেই থানও এক ঝটকায় খুলে নিল তিনজন, পাড়ার মোড়ে
একটি সদ্য নগ্ন বিধবা মেয়ে দৌড়াচ্ছে আর চিৎকার করছে, ‘বাঁচাও’
পেছনে তিনজন, সে কি উল্লাস, নির্বাক পাড়ার লোকেরা ।

বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে আরো ছটা....

সাদা-কালো--সাইদ জামান

সাদা-কালো
        --সাইদ জামান

আমি রং বদলানো গিরগিটি দেখেছি
দেখেছি বেলফুলের শুভ্র পবিত্রতা।।
আমি সমুদ্রপারে আয়েশি সূর্যস্নান দেখেছি
দেখেছি দুর্দান্ত শীতে বস্ত্রহীন অসহায়ত্ব।।
আমি বাবুই পাখির শৈল্পিক নিবাস দেখেছি
দেখেছি ছাপরা ঘরে গুটিসুটি মানবতা।।
আমি কৃষ্ণচূড়ার ডালে আগুনরঙ্গা ফুল দেখেছি
দেখেছি সাম্প্রদায়িকতার আগুনে পুড়ে যাওয়া সিঁথির সিঁদুর।।

আমি দেখেছি আমি হেসেছি
আমি দেখেছি আমি কেঁদেছি
কখনও হাসতে হাসতে কেঁদেছি
কখনও কাঁদতে কাঁদতে হেসেছি।।

সোমবার, ৬ জানুয়ারী, ২০১৪

সুধাংশু যাবে না-- শামসুর রাহমান।

সুধাংশু যাবে না
-- শামসুর রাহমান।

লুণ্ঠিত মন্দির, আর অগ্নিদগ্ধ বাস্তুভিটা থেকে ...
একটি বিবাগী স্বর সুধাংশুকে ছুঁলো
‘আখেরে কি তুলি চলে যাবে?’ বেলা শেষে
সুধাংশু ভস্মের মাঝে খুঁজে
বেড়ায় দলিল, ভাঙা চুড়ি, সিঁদুরের স্তব্ধ কৌটা,
স্মৃতির বিক্ষিপ্ত পুঁতিমালা।

স্বর বলে, ‘লুটেরা তোমাকে জব্দ ক’রে
ফেলে আশে পাশে
তোমার জীবনে নিত্যদিন লেপ্টে থাকে
পশুর চেহারা সহ ঘাতকের ছায়া,
আতঙ্কের বাদুড় পাখার নিচে কাটাচ্ছ প্রহর,
তবু তুমি যেও না সুধাংশু।’
আকাশের নীলিমা এখনো
হয়নি ফেরারি, শুদ্ধাচারী গাছপালা
আজও সবুজের
পতাকা ওড়ায়, ভরা নদী
কোমর বাঁকায় তন্বী বেদিনীর মতো।
এ পবিত্র মাটি ছেড়ে কখনো কোথাও
পরাজিত সৈনিকের মতো
সুধাংশু যাবে না।

ইচ্ছে ছিলো-হেলাল হাফিজ

ইচ্ছে ছিলো

           -হেলাল হাফিজ


ইচ্ছে ছিলো তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো
ইচ্ছে ছিলো তোমাকেই সুখের পতাকা করে
শান্তির কপোত করে হৃদয়ে উড়াবো।

ইচ্ছে ছিলো সুনিপূণ মেকআপ-ম্যানের মতো
সূর্যালোকে কেবল সাজাবো তিমিরের সারাবেলা
পৌরুষের প্রেম দিয়ে তোমাকে বাজাবো, আহা তুমুল বাজাবো।
ইচ্ছে ছিলো নদীর বক্ষ থেকে জলে জলে শব্দ তুলে

রাখবো তোমার লাজুক চঞ্চুতে,
জন্মাবধি আমার শীতল চোখ
তাপ নেবে তোমার দুচোখে।

ইচ্ছে ছিল রাজা হবো
তোমাকে সাম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,
আজ দেখি রাজ্য আছে
রাজা আছে
ইচ্ছে আছে,
শুধু তুমি অন্য ঘরে।

শনিবার, ৪ জানুয়ারী, ২০১৪

নত হও,কুর্নিশ করো- - রফিক আজাদ।

নত হও,কুর্নিশ করো
               - - রফিক আজাদ।

হে কলম, উদ্ধত হয়ো না, নত হও, নত হতে শেখো,
তোমার উদ্ধত আচরনে চেয়ে দ্যাখো, কী যে দু:খ
পেয়েছেন ভদ্রমহোদয়গণ,
অতএব, নত হও, বিনীত ভঙিতে করজোড়ে
ক্ষমা চাও, পায়ে পড়ো, বলো: কদ্যপি এমনটি হবে না, স্যার,
বলো: মধ্যবিত্ত হে বাঙালী ভদ্রমহোদয়গণ,
এবারকার মতো ক্ষমা করে দিন
বলো হে কলম, হে বলপেন, হে আমার বর্বর প্রকাশ-ভঙিমা-
এই নাকে খত দিচ্ছি আর কখনো গালমন্দ পারবো না,
আপনাদের ভন্ডামিকে শ্রদ্ধা করতে শিখবো,
আপনাদের অপমান হজম করার অপরিসীম ক্ষমতাকে সম্মান করবো,
আর কোনদিন এমনটি হবে না, হে মহামান্য মধ্যবিত্ত রুচিবোধ,
আপনাদের মতো সব অপমান হজম করে, এখন থেকে,
নাইট সয়েল বানিয়ে ফেলে দেবো শরীরের বাইরে-
হে বন্য লেখনী, হে অমোচনীয় কালি, হে ইতর বলপেন,
নত হও, নত হতে শেখ..
শান্ত হও, ভদ্র হও ভদ্রলোকের মতো
আড়াল করতে শেখো অপ্রিয় সত্যকে,
প্রিয় মিথ্যা বলা শিখে নাও, বিক্রি করে দাও তোমার বিবেক-
উচ্চারন কোরো না এমন শব্দ, যা শুনে আহত হবেন তাঁরা-
নত হও, নত হতে শেখ;
তোমার পেছনে রয়েছে যে পবিত্র বর্বর মন ও মস্তিস্ক
তাকে অনুগত দাসে পরিণত হতে বলো,
হে আমার অবাধ্য কলম, ক্রোধ সংবরণ করো,
ভদ্রলোকের মতো লেখো, ভদ্রলোকদের দ্বারে ধর্না দিও-
শিখে নাও সাজানো-গোছানো প্রভুপ্রিয় বাক্যাবলি


হে কলম, এইবার নত হও, নতজানু হও,

রফিক আজাদ সম্পর্কে জানতে ঘুরে আসতে পারেন নিচের লিঙ্ক গুলতেঃ
১. উইকিপিডিয়া। 
২. কবির অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ইমদাদুল হক মিলন এর স্মৃতি চারনায়।